বিশ্বকে চমকে দিয়ে মাথায় উঠেছিল বিশ্বসুন্দরীর তাজ। দেশে ফিরে পেয়েছিলেন মডেলিং ও অভিনয়ের অজস্র সুযোগ। কিন্তু সে সব দিকে পা রাখেননি রীতা ফারিয়া। তিনি পূর্ণ করেছেন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন।
শুধু প্রথম ভারতবাসী হিসাবেই নন, ১৯৬৬ সালে প্রথম এশীয় হিসেবে মিস ওয়ার্ল্ড খেতাব জয়ী হন।
রীতার জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৩ অগস্ট। ব্রিটিশ ভারতের বম্বে শহরে। তাঁর বাবা মা আদতে গোয়ার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাবা কাজ করতেন মিনারেল ওয়াটার প্ল্যান্টে। মায়ের একটি বিউটি পার্লার ছিল।
গ্রান্ট মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী, ২৩ বছর বয়সি রীতা কিছুটা মজা করেই যোগ দিয়েছিলেন ‘মিস বম্বে’-র মঞ্চে। ছবি তোলাবার জন্য দিদি ফিলোমেলার সঙ্গে স্টুডিয়ো গিয়েছিলেন ৫ ফিট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার রীতা।
‘মিস মু্ম্বই ক্রাউন’ জয়ী হওয়ার পরে রীতা ১৯৬৬ সালে ‘ইভস উইকলি মিস ইন্ডিয়া’ মঞ্চেও বিজয়িনী হন।
সে বছর ‘ফেমিনা মিস ইন্ডিয়া’ হয়েছিলেন ইয়াসমিন ডাজি। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে। তবে প্রথম তিন জনের মধ্যে থাকতে পারেননি।
অন্যদিকে ডার্ক হস রীতাও মিস ওয়ার্ল্ডের মঞ্চে প্রতিযোগিতা শুরুর আগে সম্ভাব্য বিজয়িনীদের মধ্যে ছিলেন না।
সে বার লন্ডনের ওয়েলিংটন স্ট্রিটের লাইসিয়াম বলরুমে বসেছিল প্রতিযোগিতার আসর। কে বিজয়িনী হবেন, তা নিয়ে জমে উঠেছিল লন্ডনের বুকিদের খেলা।
৬৬ জন সুন্দরীর মধ্যে বুকিদের বাজি ছিল সে বারের মিস লন্ডন জেনিফার লোয়ি। আর রীতা? তাঁর জন্য বাজি ধরেছিলেন মাত্র এক জন প্রবাসী ভারতীয়।
অপ্রত্যাশিত ভাবে সেই মঞ্চে বিজয়িনী হন রীতা ফারিয়া। বাজিতে জয়ী হয়ে রাতারাতি কপাল বদলে যায় ওই প্রবাসী ভারতীয়র।
জীবন বদলে যায় রীতারও। তিনি আশা করেননি বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে ঢুকে পড়বেন গ্ল্যামারবৃত্তে।
সারা পৃথিবীর সুন্দরীদের সঙ্গে টক্কর দিতে রীতার সম্বল ছিল সুটকেস ভর্তি ধার করা জামাকাপড়, মেক আপ কিটে কয়েকটা লিপস্টিক, পার্সে তিন পাউন্ড। প্রতিযোগিতায় যাওয়ার আগে ছিল না পাসপোর্ট-ও।
মুম্বইয়ের উচ্চবিত্ত সমাজে পরিচিত এক মহিলার কাছ থেকে রীতা চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা শাড়ি। বেদিং সুট দিয়েছিলেন ১৯৬৫ সালের মিস ইন্ডিয়া খেতাবজয়ী পার্সিস খাম্বাট্টা।
কিন্তু পার্সিসের উচ্চতা তাঁর তুলনায় কিছুটা কম ছিল। ফলে সেই স্নানপোশাক কোনওভাবেই মানায়নি রীতাকে। প্রতিযোগিতার সঙ্গে বেমানান ছিল তাঁর জুতোজোড়াও।
পরে এক সাক্ষাৎকারে রীতা জানান, তিন পাউন্ড দিয়ে তিনি লন্ডন থেকে আরও একটি পোশাক ও জুতো কেনেন। তবে সে দিনের পরে দুটোর কোনওটাই ব্যবহার করেননি। তবে কাছে রেখে দিয়েছেন এখনও।
তাঁর সঙ্গে রয়েছে সেই লাজুক অথচ আত্মপ্রত্যয়ী হাসিও। যা দিয়ে অর্ধশতকেরও বেশি আগে তিনি জয়ী করেছিলেন তামাম দুনিয়া।
রীতার ধারণা, তাঁর উচ্চতা ও ব্যক্তিত্ব-ই বাজিমাত করেছিল। তাছাড়া তিনি যে ডাক্তারির ছাত্রী, সেটাও তুরুপের তাস হিসেবে কাজ করেছিল।
প্রশ্নোত্তর পর্বে রীতা জানিয়েছিলেন, পরে তিনি চিকিৎসকই হতে চান। এই উত্তরে মুগ্ধ হয়ে ন’জনের মধ্যে সাতজন বিচারকই রীতাকে বেছে নেন মিস ওয়ার্ল্ড হিসেবে।
শিরোপা পাওয়ার পরে এক বছর মিস ওয়ার্ল্ডের নির্ধারিত কাজ করেছিলেন রীতা ফারিয়া। তার পর আর থাকতে চাননি গ্ল্যামার দুনিয়ায়। ফিরে গিয়েছিলেন ডাক্তারির পাঠক্রমে।
তবে এ বার আর ভারতে নয় রীতা ডাক্তারি পড়লেন লন্ডনের কিংস কলেজে। সেখান থেকেই পেলেন এমবিবিএস ডিগ্রি।
কিংস কলেজেই আলাপ আইরিশ চিকিৎসক ডেভিড পাওয়েলের সঙ্গে। তিনি ছিলেন রীতার শিক্ষক। আগেই টেলিভিশনে রীতাকে দেখে মুগ্ধ ছিলেন ডেভিড। এরপর প্রেম গাঢ় হতে সময় লাগেনি।
১৯৭১ সালে দু’জনে বিয়ে করেন। তারপর দু’জনেই চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বস্টনে। দুই মেয়ের জন্মের পরে তাঁরা চলে যান আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে।
দুই মেয়েকে বড় করার জন্য কিছুদিন ডাক্তারি থেকে দূরে ছিলেন রীতা। মেয়েরা বড় হতেই আবার ফিরে আসেন পেশায়।
অবসরের অনেকটা জুড়ে থাকেন দুই মেয়ে-জামাই এবং পাঁচ নাতিনাতনি। ভালবাসেন গল্ফ খেলতে, স্কি এবং রান্না করতে।
ডাক্তারি পড়ার সময়ে যে রীতা ডিমসিদ্ধর ‘রেসিপি’ জানতে চেয়েছিলেন ডেভিডের কাছে, দীর্ঘ দাম্পত্যে তিনি এখন রন্ধনপটিয়সী।
ভুলে যাননি ভারতকেও। প্রতি বছর নিয়মিত আসেন এ দেশে, পরিজনদের কাছে। প্রাক্তন এই বিশ্বসুন্দরীর কাছে গ্ল্যামারের চাকচিক্যের থেকে সম্পর্কের নিশ্চিন্ত আশ্রয় অনেক বেশি ভালবাসার।