একমাথা এলোমেলো চুল। দু’টি স্বপ্নালু কিন্তু বাঙ্ময় চোখ। সংলাপ কম থাকলেও স্ক্রিনে তাঁর উপস্থিতি এড়িয়ে যেতে পারতেন না দর্শকরা। তাঁদের মনে দাগ কেটেও চলে গিয়েছিলেন ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে। বলিউড থেকে সরে গিয়ে কাজ করছিলেন বিদেশে। বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন দর্শকস্মৃতি থেকেও। ফিরে এলেন নিজের মৃত্যুসংবাদে। তিনি, অভিনেতা রঞ্জিত চৌধুরি।
রঞ্জিতের জন্ম ১৮৫৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। তাঁর মা পার্ল ছিলেন নামী নাট্যব্যক্তিত্ব। পার্লের বাবা ছিলেন ক্রিশ্চান। মা ছিলেন ভারতীয় ইহুদি। ছোট থেকেই মিশ্র সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত ছিলেন রঞ্জিত। তিনি আর তাঁর বোন রোহিণী যখন ছোট, বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁদের বাবা-মায়ের।
প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে পার্ল বিয়ে করেন অ্যালেক পদমসিকে। এর পর তিনি পরিচিত হন পার্ল পদমসি নামে। পরে এই দ্বিতীয় বিয়ে ভেঙে গেলেও পার্ল ব্যবহার করতেন ‘পদমসি’ পরিচয়ই। তাঁর সন্তানদেরও ছিল ‘চৌধুরি’ পদবি-ই।
দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক বছর পরে মারা যায় পার্লের মেয়ে, রোহিণী। কয়েক বছর পরে জন্ম হয় তাঁর ও অ্যালেকের মেয়ে, রায়েলের। এর কয়েক বছরের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায় অ্যালেক ও পার্লের। পরে পার্ল আর বিয়ে করেননি। অ্যালেক আরও দু’বার বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন ডলি থাকোরে। তৃতীয় বার তিনি বিয়ে করেন শ্যারন প্রভাকরকে।
মঞ্চাভিনেত্রী মা পার্লের কাছেই অভিনয়ের হাতেখড়ি রঞ্জিতের। তিনি পড়তেন মুম্বইয়ের ক্যাম্পিয়ন স্কুলে। সেখানেই শুরু অভিনয়।
বাসু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘খাট্টা মিঠা’ ছবিতে প্রথম অভিনয় রঞ্জিতের। ছবি মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। ক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন বাসু চট্টোপাধ্যায় ও হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয় অভিনেতা। বাসু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মিষ্টি রোম্যান্টিক ছবি ‘বাতোঁ বাতোঁ মেঁ’-তে তিনি ছিলেন সভি পেরেরা। এই দু’টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রঞ্জিতের মা’ও।
তবে হিন্দি ছবির দর্শক রঞ্জিতকে সবথেকে বেশি মনে রেখেছেন ‘খুবসুরত’ ছবির জগন গুপ্ত হিসেবে। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮০ সালে। এর পর ‘কালিয়া’, ‘ব্যান্ডিট কুইন’, ‘কামসূত্র’, ‘ফায়ার’-সহ বিভিন্ন ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। মীরা নায়ারের পরিচালনায় ‘মিসিসিপি মসালা’ ছবিতে ডেনজেল ওয়াশিংটনের চরিত্রে অভিনয় তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য।
আশির দশকেই আমেরিকা চলে যান রঞ্জিত। সেখানেও অভিনয় এবং লেখালেখি করেছেন। মার্কিন বিনোদন জগতে ‘দ্য অফিস’ এবং ‘প্রিজন ব্রেক’ শো-এ নজর কাড়েন রঞ্জিত। তার পরেও তিনি কাজ করেছেন বলিউডে।
‘বলিউড হলিউড’, ‘লাস্ট হলিডে’, ‘ল অ্যান্ড অর্ডার এসইউইভি’, ‘স্যাম অ্যান্ড মি’, ‘ইট কুড হ্যাপেন টু ইউ’, ‘দ্য পেরেজ ফ্যামিলি’, ‘লাস্ট হলিডে’, ‘কেটল অব ফিশ’ এবং ‘কাঁটে’—দেশ ও বিদেশের বিনোদন দুনিয়ায় তাঁর বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে নজর কাড়েন এই চরিত্রাভিনেতা। তাঁকে শেষ বার পর্দায় দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালে, কানাডিয়ান কমেডি ছবি ‘ব্রেকওয়ে’-তে।
রঞ্জিতের স্ত্রী এবং ছেলে থাকেন নিউইয়র্কে। তিনি গত বছর ডিসেম্বরে মুম্বই এসেছিলেন দাঁতের চিকিৎসা করাতে। ৮ এপ্রিল ফিরে আমেরিকা ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লকডাউনের জেরে তিনি আটকে পড়েন ভারতেই।
ক্ষুদ্রান্তে আলসারের সংক্রমণের জেরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে ভর্তি করা হয় মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে। চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারও করেন। কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৫ এপ্রিল প্রয়াত হন এই অভিনেতা। বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।
ভারতে তাঁর পরিজনদের পাশাপাশি রঞ্জিতের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন বলিউডের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বও। (ছবি: ফেসবুক)