ঘরোয়া মেজাজে আশা-লতা
দুই বোন, সাজিয়ে দিচ্ছে একে অন্যকে। ‘মন কিউঁ বেহকা রে বেহকা আধি রাত কো...’র সুরে দুই বোনের কণ্ঠ পর্দায় মায়াবী করে তুলছে এক রাতের দৃশ্য। লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের সুরে লতা মঙ্গেশকর এবং আশা ভোঁসলের দ্বৈত সঙ্গীত। একসঙ্গে খুব বেশি বার কণ্ঠ মেলাননি তাঁরা। দু’জনের যাত্রাপথও স্বতন্ত্র। তাঁদের ‘রেষারেষি’ নিয়ে চর্চা, বিতর্ক কম নেই। তবু মনে রাখতে হবে, হিন্দি মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রির সর্বকালের সেরা দুই শিল্পী আদতে সহোদরা। আশা এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে একবার প্রশ্নকর্তাকে বলেছিলেন, ‘‘জানেন তো, রক্ত জলের চেয়েও ঘন?’’ দুই বোনের সাঙ্গীতিক দ্বৈরথ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময়ে অনেকেই ভুলে যান, ছোট বোন আশাকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে স্কুল ছেড়ে চলে এসেছিলেন তাঁর ‘লতাদিদি’।
দীননাথ মঙ্গেশকরের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় লতার উপরে ভাইবোন আর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছিল অপরিণত বয়সেই। বাবার চলে যাওয়া এক ঝটকায় বড় করে দিয়েছিল তাঁকে, পেশাদার ভাবে ছবিতে অভিনয়-গানের শুরুও সেখান থেকেই। ‘দুনিয়াদারি’র সঙ্গে ছোট বয়স থেকেই পরিচয় হয়ে গিয়েছিল বলেই বোধহয় ভাইবোনদের ব্যাপারে একটু বেশিই রক্ষণশীল ছিলেন লতা। সেই কারণেই হয়তো মেনে নিতে পারেননি বোন আশার মাত্র ষোলো বছর বয়সে বিয়ের সিদ্ধান্ত। বস্তুত, আশার সেই সিদ্ধান্তই নাকি তাঁর সঙ্গে সাময়িক দূরত্ব তৈরি করেছিল মঙ্গেশকর পরিবারের। তাঁর প্রিয় লতাদিদিরও। যদিও ছোটবেলায় তিনিই দিদির ‘প্রিয়’ বোন ছিলেন। নাসরিন মুন্নি কবীরের সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই ‘লতা মঙ্গেশকর: ইন হার ওন ভয়েস’-এ আশা লিখছেন, ‘‘ছোটবেলায় ভাইবোনদের মধ্যে আমিই ছিলাম দিদির সবচেয়ে কাছের। আমাকে কোলে নিয়ে ছুটে বেড়াত সারাক্ষণ।’’ ‘সেকেন্ড বেস্ট’ তকমা নিয়েও দিদিকে শিল্পী হিসেবে কোন জায়গায় রাখতেন আশা, তারও আভাস মেলে বইয়ে।
তবে অভিমানের চোরা স্রোত কি একেবারেই ছিল না? শোনা যায়, ‘অ্যায় মেরে ওয়তন কে লোগো’ প্রথমে গাওয়ার কথা ছিল আশা ভোঁসলের। সুরকার সি রামচন্দ্রের সঙ্গে রিহার্সালও দিয়েছিলেন আশা। অন্য দিকে, গীতিকার কবি প্রদীপ গানটি তাঁকে দিতে চাননি। লতার কাছে প্রস্তাব যাওয়ার পরে একসঙ্গে মহড়াও দেন দুই বোন। শেষ পর্যন্ত দিল্লিতে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে গেয়েছিলেন লতাই।
হিন্দি প্লেব্যাকে সুরাইয়া-শমশাদ পরবর্তী সময়ে যেমন ‘পাতলি আওয়াজ়’ নিয়েও জায়গা তৈরি করে নিচ্ছিলেন লতা, অন্য দিকে স্বকীয়তায় গীতা দত্তের শূন্যস্থান পূরণ করছিলেন আশা। ও পি নাইয়ার, আর ডি বর্মণের হাত ধরে বৈচিত্রের যে নিজস্ব ‘ঘরানা’ তৈরি করলেন আশা, তা নিয়ে গর্বিত ছিলেন তাঁর দিদি। পরবর্তী কালে প্রকাশ্যে স্বীকার করতেন, আশার মতো সব ধরনের গান তিনি গাননি। যশ চোপড়া একবার বলেছিলেন, ‘‘আমার ছেলের (আদিত্য চোপড়া) প্রথম ছবি ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’র জন্য লতাজির কাছেই প্রথম যাই। তিনি বলেছিলেন, ‘জ়রা সা ঝুম লু ম্যায়’ ভাল গাইবে আশা।’’ ‘গান কেড়ে নেওয়া’র বিপরীতে এমন উদাহরণও ছিল। আর সেই কারণেই তাঁদের নামের পাশে ‘প্রথম’ বা ‘দ্বিতীয়’র র্যাঙ্কিং চলে না। সেই কারণেই তাঁরা কিংবদন্তি।