সঙ্গীতের প্রতি তাঁর প্রেম, বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাত্রা— সব নিয়ে অকপট চমক হাসান। —ফাইল চিত্র।
তিনি আমেরিকাবাসী ইঞ্জিনিয়ার। পেশা যা-ই হোক না কেন, সঙ্গীত তাঁর জীবনের অন্যতম ভালবাসা। জন্ম বাংলাদেশে। বর্তমানে তাঁর পরিচিত অবশ্য ছড়িয়ে গিয়েছে চারিদিকে। তিনি চমক হাসান। নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত ছবি ‘ফাটাফাটি’ ছবিতে তাঁর গাওয়া গান শুনবেন দর্শক। ছবি মুক্তির আগে বাংলাদেশ থেকে তাঁর আমেরিকা যাত্রার গল্প এবং অবশ্যই গানের প্রতি ভালবাসার কথা আনন্দবাজার অনলাইনের সামনে তুলে ধরলেন গায়ক।
প্রশ্ন: আমেরিকায় এখন ক’টা বাজে?
চমক: আমার এখানে এখন রাত সাড়ে ১১টা। আপনাদের ওখানে তো দুপুর।
প্রশ্ন: আমেরিকার কোথায় থাকেন আপনি?
চমক: আমি এখন থাকি লস এঞ্জেলেসে। আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে বললাম বলে দুঃখিত। আসলে রাত হয়েছে, মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম।
প্রশ্ন: তার মানে বাড়ির কাজ করা হয়?
চমক: হ্যাঁ, চেষ্টা করি (হাসি)। আমার দুই মেয়ে। এক জন তো বেশ ছোট। তাই যতটা পারি স্ত্রীকে (বহ্নি) সাহায্য করার চেষ্টা করি।
গণিত না সঙ্গীত— তাঁর জীবনে কার গুরুত্ব বেশি? —ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন: আপনার তৈরি ‘এই মায়াবী চাঁদের রাতে’ গানটি তো এখনও শ্রোতাদের প্লে-লিস্টে রয়ে যায়। ‘বাবা বেবি ও’ ছবিটা মুক্তির পর এই এক বছরে জীবন কতটা বদলেছে?
চমক: খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। এর মধ্যে আমি আবার বাবা হয়েছি। ব্যক্তিগত ব্যস্ততা বেড়েছে। ফলে সঙ্গীত নিয়ে যতটা চর্চা করার দরকার ছিল, ততটা আর করে উঠতে পারিনি।
প্রশ্ন: নিজের দেশ ছেড়েছেন কত বছর?
চমক: ২০১১ সাল থেকে আমি ভিন্দেশে। প্রায় ১২ বছর হয়ে গেল বাংলাদেশ থেকে দূরে রয়েছি।
প্রশ্ন: এক যুগ! দীর্ঘ সময় নিজের শিকড়ের থেকে দূরে। কী উপলব্ধি করেন?
চমক: আসলে কোনও জিনিসকে আমরা যখন দূর থেকে দেখি তখন সেই দেখাটা একটু অন্য রকম হয়। দেশের সংস্কৃতি, পরিবেশ মিস করি খুব। দেশ থেকে দূরে থাকা, কিংবা কাছের মানুষগুলোর থেকে দূরে থাকা তৈরি করে এক অদ্ভুত নস্ট্যালজিয়া। আমার গানে সেই অনুভূতিগুলোই বার বার চলে আসে।
প্রশ্ন: আপনার বাড়িতে কি ছোটবেলা থেকে গানবাজনার চর্চা ছিল?
চমক: না, সেই ভাবে বাড়িতে কোনও গানের চর্চা ছিল না। আসলে আমার বড় হওয়া কুষ্টিয়ায়। আশপাশে গানবাজনার চর্চা ভালই ছিল। সেখানেই যেতাম। সঙ্গীতগুরুর কাছে তেমন ভাবে কোনও প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়নি আমার, তবে পরিবেশটা বরাবর পেয়েছি। বন্ধুদের মধ্যেও গানের চর্চা ছিল।
প্রশ্ন: আপনি এক দিকে ইঞ্জিনিয়ার, গণিত নিয়ে গবেষণা করেছেন। সঙ্গে আবার গান। গানের সঙ্গে গণিতের হিসেব মিলল কী ভাবে?
চমক: গান এবং গণিত— দুটোই আমার কাছে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম। আমার কাছে আলাদা বলে মনে হয় না। কয়েক যুগ আগে এমন অনেক বিজ্ঞানী ছিলেন, যাঁরা একসঙ্গে গবেষণাও করেছেন আবার কবিতার চর্চাও করেছেন। আমরা কৃত্রিম ভাবে দুটোকে আলাদা করে ফেলেছি। গণিত এবং গানের মিলনক্ষেত্র হল কল্পনা। কল্পনাগুলোকে একসূত্রে বাঁধার জন্য আমরা গণিত ব্যবহার করি। সেই সূত্র, সেই আবেগকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করি গান। আমি তাই অনেক মিল খুঁজে পাই।
প্রশ্ন: সময়ের সঙ্গে আপনার পরিচিতি বেড়েছে। মনের মধ্যে বিখ্যাত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কি কখনও তৈরি হয়েছিল?
চমক: ‘আকাঙ্ক্ষা’ শব্দটা কঠিন। ছোটবেলা থেকেই আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। জানি না কেন, নিজের গণ্ডিতে বরাবরই আমার পরিচিতি ছিল। হয়তো ভাল ছাত্র ছিলাম তাই। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। তাই এখনও যখন পরিচিতি বাড়ে সেটাকে আলাদা কিছু মনে হয় না। অনেক বেশি খ্যাতি আমায় আকর্ষণ করে না।
প্রশ্ন: নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটির সঙ্গে আলাপ কী করে হল?
চমক: সে এক লম্বা গল্প। আমি আর আমার স্ত্রী কথা বলতে বলতে গান বেঁধে ফেলি। হয়তো আমি পাশের ঘরে আছি। জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তা দেখে একটা লাইন আমি আমার স্ত্রীকে মেসেজ করে পাঠালাম। ও তখন উত্তরে আমায় ছন্দ মিলিয়ে আর একটা লাইন লিখে পাঠাল। করোনা পরিস্থিতিতে বাড়িতে বন্দি থাকাকালীন এই ভাবেই বেঁধেছিলাম ‘এই মায়াবী চাঁদের রাতে’। যে গানটা ইউটিউবে আামরা পাবলিশ করি। সেটা শুনে প্রথমে জিনিয়া সেনের (‘বাবা বেবি ও’ সিনেমার ভাবনা যাঁর) পছন্দ হয়। তার পর শিবপ্রসাদ শোনেন। এই গানটা মূলত নিজেদের স্মৃতি হিসাবেই তৈরি করেছিলাম।
চমকের জীবনে প্রথম গুরুত্ব তাঁর পরিবার। —ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন: অর্থাৎ, আপনার গানের কিছুটা কৃতিত্ব স্ত্রী বহ্নির দিকেও বর্তায়?
চমক: অবশ্যই। এই গানই তো আমাদের বেঁধেছিল। আমরা দু’জনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। সেখানে একটা গানের অনুষ্ঠানেই আমাদের প্রথম আলাপ। গানই আমাদের মিলিয়েছিল। তার পরেই আমাদের একসঙ্গে পথ চলা শুরু। দুই মেয়েকে নিয়ে এখন আমাদের সুখের সংসার।
প্রশ্ন: চমক হাসান বাবা হিসাবে কেমন?
চমক: আমি যে খুব দায়িত্ববান, সেটা দাবি করাটা একটু কঠিন হতে পারে। চেষ্টা করি ওদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে। মনে হয় খুব খারাপ বাবা হব না (হাসি)।
প্রশ্ন: কলকাতার আর কোনও পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?
চমক: না, তা হয়নি । শিবুদারা ছাড়া আর কেউ যোগাযোগও করেননি।
প্রশ্ন: আগামী দিনে পেশাদার সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে আপনাকে দেখা যাবে কি?
চমক: না, সেটা হয়তো করা হবে না। পেশাদার শিল্পী হিসাবে কাজ হয়তো করতে পারব না। তবে এই একটা-দুটো যেমন গান করছি সেটা হয়তো করব। আমি অল্পেতেই খুশি। পুরো সময় দিতে পারব না। সেটা আমি চাইও না।
প্রশ্ন: তা হলে কোনও প্রায়োরিটি তালিকা তৈরি হলে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থানে থাকবে কারা?
চমক: (একটু ভেবে) খুবই কঠিন প্রশ্ন। প্রথমেই থাকবে আমার পরিবার। আর দ্বিতীয় স্থানে একই সঙ্গে গণিত এবং গান। কারণ এই দুটোই আমার ভালবাসা।