প্রবুদ্ধ
প্র: জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরে কতটা পাল্টেছে জীবন?
উ: এই পুরস্কার খুবই সম্মানজনক, সন্দেহ নেই। তবে পুরস্কার পাওয়ার পরে যে বিরাট কিছু পরিবর্তন হয়েছে, তা নয়। কাজকর্ম আগের মতোই চলছে। যাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে এই পুরস্কার পাওয়া, সেটা ভাবতে অবাকই লাগে। আসলে কলকাতায় অনেক সীমাবদ্ধতা, বাধাবিপত্তির মধ্যে কাজ করতে হয়। মুম্বই এবং দক্ষিণের ইন্ডাস্ট্রিতে যে বাজেটে, যে মানের কাজ হয়, তা এ শহরে ভাবা যায় না এখনও। তবে এ নিয়ে আক্ষেপ করায় বিশ্বাসী নই আমি। ভাল কাজ করার বাধা কিন্তু বাজেটে নয়, মগজে। বাজেট দিয়ে না পারি, মগজ দিয়ে মারব (হাসি)!
প্র: আপনার ইচ্ছে করে না অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে কাজ করতে?
উ: হয়তো কোনও দিন করব। হিন্দিতে ‘নজ়রবন্দ’, ‘পোশম পা’-এর মতো ছবি করেছি আগে। ভাল ভাল মিউজ়িশিয়ানের সঙ্গে কোলাবরেট করা তো যে কোনও শিল্পীরই স্বপ্ন। সম্প্রতি রিলিজ় করা ‘অজীব দাস্তানস’ সিরিজ়ে বুডাপেস্ট ফিল্ম অর্কেস্ট্রাকে ব্যবহার করা হয়েছে দেখলাম। কলকাতায় বসে এ সব কাজ ভাবাই যায় না!
প্র: তার একটা কারণ কি ছবি বা সিরিজ়ে সঙ্গীতের গুরুত্ব বাড়ছে বলে?
উ: অবশ্যই। শুধু গান নয়, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের গুরুত্বও। একটা ছবিতে ২-৩টে গান থাকলেও তা গোটা ছবির ১০-১৫ মিনিট জুড়ে থাকে। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর পুরো ছবি জুড়েই থাকে। তবে এখানে মিউজ়িক ডিরেক্টর আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরারকে আলাদা চোখে দেখা হয় এখনও।
প্র: আপনার চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর মিউজ়িকে আসা কী ভাবে?
উ: চার বছর বয়স থেকে গানবাজনা করছি। ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজ়িকে ভায়োলিন শিখতাম। তা ছাড়া আর সব বাদ্যযন্ত্রই নিজে শেখা। যেমন গিটার শিখেছি পিট সিগার শুনে। যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ১৮ বছর চাকরি করেছি। নব্বইয়ের দশকে অভীক মুখোপাধ্যায়ের একটা তথ্যচিত্রে কাজের সুযোগ এসেছিল। ২০০০ সাল নাগাদ অভীকই আমার কাছে একটা বিজ্ঞাপনের কাজ নিয়ে এল। ১৫ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন দেখে ওকে বলেছিলাম, সময়টা বাড়ানো যাবে না? অভীক জবাব দিয়েছিল, ১৫ সেকেন্ড তো অনেক সময়! পরবর্তীকালে বিজ্ঞাপনের কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, তার একটা আলাদাই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই সময় থেকেই কম্পোজ় করতাম। সারাদিন অফিস করার পরে সারা রাত মিউজ়িক নিয়ে পড়ে থাকতাম। শেষে ২০০৩ সালে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।
প্র: আপনার প্রথম ছবি ‘ভাল থেকো’ও তো সেই সময়েই করা?
উ: হ্যাঁ। ওই ছবিটা আমাদের অনেকেরই প্রথম ছবি ছিল। পরিচালক গৌতম হালদার, বিদ্যা বালন, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, দেবশঙ্কর হালদার, আমি... সকলেরই প্রথম ছবি ‘ভাল থেকো’। ভাবতে অদ্ভুত লাগে, আমার জীবনের প্রথম ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। আর ওঁর শেষ ছবি ‘অভিযান’-এও মিউজ়িক করছি।
প্র: এই মুহূর্তে কীসের কাজে ব্যস্ত?
উ: ‘অভিযান’-এর শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ চলছে। এর পরে রয়েছে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘অতি উত্তম’, যেখানে কাজটা টেকনিক্যালি চ্যালেঞ্জিং। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাবেরী অন্তর্ধান’ও রয়েছে।
প্র: এখনও পর্যন্ত করা কাজের মধ্যে নিজের সবচেয়ে পছন্দের কোনগুলি?
উ: ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর ‘ফড়িং’-এর কথা বলতে চাই। ওঁরই শর্ট ফিল্ম ‘ভালবাসার শহর’-এর মিউজ়িক করেও আনন্দ পেয়েছিলাম। ‘নগরকীর্তন’ ছিল কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। ওঁর ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’র জন্য জাতীয় পুরস্কার পেলেও আমার মতে ‘নগরকীর্তন’-এর মিউজ়িক অনেক বেশি পরিণত। ছবির মিউজ়িক করতে গিয়ে আমি কীর্তনের ধারকাছ দিয়ে যাইনি। তা শুনে কৌশিক প্রথমটায় খুব অবাক হলেও প্রশংসা করেছিল। বৃহন্নলাদের দিয়ে ব্যাকআপ ভোকালস করিয়েছিলাম। ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’র চেয়েও দুঃসাহসিক কাজ ‘নগরকীর্তন’।
প্র: আপনি তো সম্প্রতি নাটকেও মিউজ়িক করেছেন...
উ: ‘চেতনা’র প্রযোজনা ‘ডন: তাকে ভাল লাগে’ মঞ্চে আমার করা প্রথম কাজ। ছাত্রাবস্থায় ‘মারীচ সংবাদ’, ‘জগন্নাথ’ দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। ‘ডন’-এর পরে ‘রানী ক্রেউসা’ করলাম। আর সম্প্রতি ‘মেফিস্টো’তে একটা গান আমি এগজ়িকিউট করে দিয়েছি মাত্র, বাকিটা সুমনের (মুখোপাধ্যায়) ভাবনা।
প্র: সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আপনার পছন্দের শিল্পী কারা?
উ: সুনিধি চৌহানের মেধা আমাকে আশ্চর্য করেছিল। আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের কথাই যদি বলতে হয়, তা হলে ময়ূখ ভৌমিকের কথা বলব। এই প্রজন্মের অসম্ভব গুণী একজন শিল্পী। এখন অসাধারণ প্রতিভাবান সব মিউজ়িশিয়ান রয়েছেন, যাঁদের অনেককেই ঠিকমতো ব্যবহার করা হয় না। এত বেশি বাজারি হয়ে গিয়েছে সব কিছু যে, তাঁরাও পপুলার মিউজ়িকের দিকে ঝুঁকছেন। মিউজ়িক এখন কমোডিটি হয়ে গিয়েছে আসলে।