কোনও ছবিকে কি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত? বিশ্লেষণে পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ এবং সুমন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
সোমবার পশ্চিমবঙ্গে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। তার পর থেকেই এ রাজ্যে শিল্পের স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। গত সপ্তাহে দেশে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। কেউ ছবিটিকে ‘প্রোপাগান্ডা’ অর্থাৎ বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছবি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোনও ছবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা কি উচিত? টলিপাড়ার বিশিষ্ট পরিচালকদের সামনে প্রশ্ন রেখেছিল আনন্দবাজার অনলাইন।
পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটি দেখেছেন। তাঁর মতে, কোনও ছবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত নয়। তিনি বললেন, ‘‘সেটা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’-ই হোক বা ‘দ্য কেরালা স্টোরি’, কারও ক্ষেত্রেই কাম্য নয়।’’ এই প্রসঙ্গেই অনিকেতের যুক্তি, ‘‘যে কোনও নিষেধাজ্ঞা পরোক্ষে সেই ছবিটিকেই সাহায্য করে। দর্শকের কৌতূহল আরও বেড়ে যায়।’’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুললেন, ‘‘তা ছাড়া আজকের দিনে ছবি নিষিদ্ধ করে কি তাকে আটকানো যায়? দু’দিন পর তো ছবিটা ওটিটিতে আসবে। তখন কি করবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার?’’
যে কোনও ছবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরিবর্তে বিকল্প পথে হাঁটার পক্ষপাতী ‘হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী’ ছবির পরিচালক। তাঁর কথায়, ‘‘এই ঘটনার পাল্টা ন্যারেটিভ নিয়ে ছবি হোক। বিভিন্ন ক্লাব, ইসলামধর্মী এবং পুরুতদের তো টাকা দেওয়া হচ্ছে। টাকা দিয়ে সরকার বা সরকার ঘনিষ্ঠরা একটা গান্ধী ফাইল্স, একটা সাভারকর ফাইল্স বা একটা গোধরা ফাইল্স তৈরি করুক না। তাতে তো ক্ষতি নেই।’’
কোনও ছবিকে নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে পরিচালক গৌতম ঘোষ তার খারাপ এবং ভাল— দু’দিকেই আলোকপাত করলেন। এক সময় সেন্সর বোর্ডের রিভাইসিং কমিটিতে শ্যাম বেনেগাল, কমল হাসনদের সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন গৌতম। তাঁর কথায়, ‘‘অরুণ জেটলির আমলে তো সেন্সর বিষয়টাকেই আরও স্বাধীন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওঁরা খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে সেটা আর চালু হয়নি।’’ এই প্রসঙ্গেই গৌতম বললেন, ‘‘আমাদের ওই প্রস্তাবে কিন্তু বলা ছিল, কোনও ছবিকে কেন্দ্র করে দেশের ধর্মীয় বা আইনের পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে সেই ছবিকে নিয়ে সরকার যে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেন।’’
তবে এখনকার ডিজিটাল যুগে কোনও ছবিকে আক্ষরিক অর্থে আটকে রাখা যায় না বলেই মনে করেন গৌতম। তাঁর কথায়, ‘‘ব্রিটিশ আমলে কিংবা পরবর্তী কালে ১৯৫২ সালে সিনেমাটোগ্রাফ আইন পাশ হওয়ার পর বলা হত, সিনেমার একটা মারাত্মক ইনফ্লুয়েন্স রয়েছে। তাই সেন্সরশিপ প্রয়োজন।’’ কিন্তু এখন জনপ্রিয়তা এবং বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ছোট পর্দা এবং ওটিটি সিনেমার তুলনায় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে বলে মনে করেন গৌতম। তিনি বললেন, ‘‘অথচ সেখানে কোনও সার্টিফিকেশন নেই। এটাই বড্ড গোলমেলে। সিনেমা তো সেখানে অনেক কম সংখ্যক দর্শক দেখেন!’’ অন্য কোথাও সেন্সরশিপ নেই, কিন্তু সিনেমায় তা বর্তমান। এই প্রসঙ্গেই অতীতের এক গল্প শোনালেন গৌতম। উল্লেখ করলেন তৎকালীন মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কথা। গৌতম বলেন ‘‘প্রিয়দা যখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন, আমি তখন ওঁকে এক বার জিজ্ঞাসা করি, আমরা যদি সরকারের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা করি তা হলে কী হবে? উনি তখন হেসে বলেছিলেন, ‘তোমরা জিতে যাবে, সরকার হেরে যাবে।’’
এই দ্বিচারিতা থেকে কী ভাবে বেরোনো সম্ভব? ‘মনের মানুষ’ ছবির পরিচালক সাফ বললেন, ‘‘আসলে আমাদের দেশে তো কেন্দ্রের সঙ্গে কোনও কোনও রাজ্যের মিলমিশ নেই। সকলে মিলে একসঙ্গে সিদ্ধান্ত না নিলে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না।’’
পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় এই মুহূর্তে নিউ ইয়র্কে রয়েছেন। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পরিচালক বলেন, ‘‘দেশের বাইরে আছি বলে আমি বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি জানি না। কিন্তু আমার মতে, যে কোনও ছবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক। বিষয়টা অনেকটা বই পোড়ানোর মতো!’’ তবে এই রাজ্যে ছবির প্রতি নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে আসা প্রসঙ্গে সুমন মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘একটা সময় নন্দনে বলা হয়েছিল ‘হারবার্ট’ দেখানো হবে না। ‘দ্য হ্যাংম্যান স্টোরি’ ছবিটির বিষয়বস্তু নিয়ে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু বাংলায় কোনও ছবি নিষিদ্ধ হয়েছে, এ রকম ঘটনা আগে শুনিনি।’’