Friendship Day 2024

চাঁদের টুকরো থেকে শুরু বন্ধুত্বের, অনিরুদ্ধ-শান্তনুর যৌথ সফরে বাধা হয়নি পেশাগত জগৎ

৪ অগস্ট, রবিবার বন্ধুদিবস। পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী ও সুরকার শান্তনু মৈত্রের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। আনন্দবাজার অনলাইনকে দুই বন্ধু শোনালেন তাঁদের একসঙ্গে পথচলার আখ্যান।

Advertisement

অভিনন্দন দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৪ ০৮:০৩
Share:

ব্রাজিল বিশ্বকাপে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী ও শান্তনু মৈত্র। ছবি: সংগৃহীত।

এক জনের সিংহভাগ ছবিতে অন্য জন সঙ্গীত পরিচালক। কর্মসূত্রেই এক সময় অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী এবং শান্তনু মৈত্রের যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সময়ের সঙ্গে তা পরিণত হয়েছে নিবিড় বন্ধুত্বে। সম্প্রতি, দক্ষিণ কলকাতার এক ক্লাবে অনিরুদ্ধ যখন আনন্দবাজার অনলাইনের সামনে দুই বন্ধুর সমীকরণকে বিশ্লেষণে ব্যস্ত, তখন শহরেরই অন্য প্রান্তে শুটিংয়ে ব্যস্ত শান্তনু। কিন্তু বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই ফোনে আড্ডার হারানো সুর ফিরিয়ে দিলেন সুরকার।

Advertisement

অনিরুদ্ধ কলকাতার বাঙালি। শান্তনু লখনউয়ের। কী ভাবে তাঁদের প্রথম আলাপ? ২০০৬ সাল। মুম্বইয়ে তখন পরিচালক রাজকুমার হিরানির ‘মুন্নাভাই সিরিজ়’-এর সঙ্গীত নিয়ে ব্যস্ত শান্তনু। তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করেন অনিরুদ্ধ। ফ্লোরে তখন গীতিকার স্বানন্দ কিরকিরে, রাজকুমার হিরানিরা রয়েছেন। তাঁদের ‘অনুরণন’-এর একটা ক্লিপিং দেখিয়েছিলেন অনিরুদ্ধ। পরিচালক বললেন, ‘‘রাজকুমার হিরানি তখন শান্তনুকে বললেন যে, আমার পরবর্তী ছবিটা ওঁকে করতেই হবে। তার পর এক দিন শান্তনুর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম।’’ শান্তনু জানালেন, সেই সময় তাঁর হাতে বিশেষ সময় ছিল না। বললেন, ‘‘আমার প্রথম বাংলা ছবি। তাই প্রথমে কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন দেখলাম, রাজুই বলছে টোনির (অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ডাকনাম) ছবিটা করতে, তখন আর দেরি করিনি।’’

অনিরুদ্ধ এবং শান্তনুর সঙ্গে আড্ডায় শ্রেয়া ঘোষাল। ছবি: সংগৃহীত।

প্রথম আলাপের প্রেক্ষাপটই গড়ে দিয়েছিল ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে। অনিরুদ্ধের হাতে উপহার হিসেবে শান্তনু তুলে দিয়েছিলেন এক টুকরো চাঁদের পাথর। অনিরুদ্ধ হেসে বললেন, ‘‘বুঝতে পারলাম, বিষয়টা জমে যাবে।’’ নিয়মিত একে অপরের বাড়িতে আসা-যাওয়া। শান্তনুর বাড়িতে পিয়োনোর আড্ডায় শরিক হন শ্রেয়া ঘোষাল থেকে শুরু করে পাপন। সকলে মিলে তৈরি হয় অন্য এক জগৎ। তবে অনিরুদ্ধের দাবি, শুধু কাজ নয়, শান্তনুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারণও। বললেন, ‘‘জীবন সম্পর্কে ওর ধারণা, মানুষের প্রতি ওর প্রেম এবং সহমর্মিতা আমাকে মুগ্ধ করে।’’ নিজের মন্তব্যের সপক্ষে উদাহরণও দিলেন অনিরুদ্ধ। মুম্বইয়ে প্রবল বৃষ্টিতে গোরেগাঁও থেকে মালাড পর্যন্ত একটি ছেলে রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে— সঙ্গীত জগতে স্ট্রাগল করছে সে। ছেলেটিকে পর দিন নিজের স্টুডিয়োয় ডেকে নেন শান্তনু। অনিরুদ্ধের কথায়, ‘‘ছেলেটিকে কিন্তু কাজ দিয়েছিল শান্তনু। সে এখন শ্রেয়ার দলের সদস্য। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই গুণ সকলের থাকে না।’’

Advertisement

মুম্বইয়ে অনিরুদ্ধের বাড়ি গোরেগাঁও ওয়েস্টে। শান্তনু থাকেন ভারসোভায়। প্রায়শই একে অপরের বাড়িতে বসে বৈঠকি আড্ডা। অনিরুদ্ধ ভোজনরসিক। আর শান্তনুর রান্নার হাতটিও খাসা। ফলে বন্ধুত্বের আরও একটি মাত্রা দু’জনের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। অনিরুদ্ধের কথায়, ‘‘হয়তো আমার খিদে পেয়েছে। শুনে শান্তনু সামান্য পেঁয়াজ ও ক্যাপসিকাম দিয়ে একটা ডিমের কিছু বানিয়ে দিল, যার স্বাদ অমৃতের মতো।’’ বিপরীতে শান্তনুর মত, অনিরুদ্ধ যে ভাবে মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করেন, সেই আতিথেয়তা অনেক কিছুকেই সহজ করে দেয়।

যেখানে জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা নেই, সেই সম্পর্ক এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন অনিরুদ্ধ। চারপাশের সমালোচনা এবং কটাক্ষের ভিড়ে শান্তনু যেন তাঁর কাছে একরাশ টাটকা বাতাস। বললেন, ‘‘হয়তো বেশ কয়েক দিন কাজের ব্যস্ততায় আমাদের কথা হচ্ছে না। তার পর ও কিন্তু ঠিক একটা মেসেজ করবে। খবরাখবর নেবে।’’ শান্তনুও বিশ্বাস করেন, শুধুই কাজের আদানপ্রদানের মাধ্যমে কোনও বন্ধুত্ব টিকে থাকে না। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, আমি যদি সুরকার না হতাম বা টোনি যদি পরিচালক না হত— তার পরেও আমাদের আলাপ হলে ভাল বন্ধু হতাম। কারণ, আমাদের অনেক মিল।’’ সঙ্গীতের জ্ঞান এবং চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে অনিরুদ্ধের উপলব্ধি তাঁর কাছে অনুপ্রেরণা বলেই জানালেন শান্তনু।

বন্ধুর কোন বিষয়টা দেখে হিংসে হয় তাঁর? অনিরুদ্ধ বললেন, ‘‘ওর রান্না করার ক্ষমতা এবং বোহেমিয়ান স্বভাব। শান্তনু যে ভাবে একশো দিন হিমালয়ে কাটিয়ে দেয় বা ৫০ দিনের জন্য সাইকেল চেপে বেরিয়ে পড়ে, সেটা কিন্তু আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’’ একই ভাবে শান্তনুর ক্ষেত্রেও হিংসে কাজ করে না। কারণ অনিরুদ্ধ জানালেন, ‘অনুরণন’ দেখে শান্তনু নাকি আবহসঙ্গীতের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। শান্তনু বললেন, ‘‘টোনি আমার ডেয়ার ডেভিল স্বভাবের কথা বললেও, ও কিন্তু কম যায় না। ও যে ভাবে এবং যে ভাবনা থেকে ছবি তৈরি করে, আমার কাছে কিন্তু সেটাও সাহসিকতাই বটে।’’ জীবনের পথে চলতে গিয়ে অনিরুদ্ধ বুঝেছেন, সবাই সর্বদা পাশে থাকেন না। আবার কিছু মানুষ নিজে থেকেই এসে দাঁড়ান। তাঁর জীবনে শান্তনুও কিছুটা সে রকমই। অনিরুদ্ধ বললেন, ‘‘আমি সব সময় মাথায় রাখি, রাইট ফ্রেন্ডস ক্যান মেক ইউ, রং ফ্রেন্ডস ক্যান ব্রেক ইউ।’’

সুযোগ পেলেই একসঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন অনিরুদ্ধ ও শান্তনু। ছবি: সংগৃহীত।

একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া থেকে শুরু করে আড্ডাগুলোই স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়। ২০১৪ সালে ব্রাজিলে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছিলেন দু’জনে। মজার গল্প শোনালেন শান্তনু। মারাকানা স্টেডিয়ামে জার্মানি বনাম ফ্রান্সের ম্যাচ। জার্মানির সমর্থকদের আসন একটু উপরের দিকে। নীচের দিকে ফ্রান্সের সমর্থকেরা বসেছেন। অনিরুদ্ধ গেলেন খাবার কিনতে। শান্তনু বললেন, ‘‘ম্যাচ শুরু হয়ে গিয়েছে, এ দিকে টোনি আসছে না। চিন্তা বাড়ছে। হাফ টাইমে আমি নীচের দিকে নেমে একটু খোঁজ করতেই দেখি ও ফ্রান্সের সমর্থকদের মধ্যে বসে রয়েছে! তাদেরই পতাকা নিয়ে জার্মান সমর্থক থেকে ফ্রান্সের সমর্থক হয়ে গিয়েছে!’’ শান্তনু কারণ জানতে চাইলে অনিরুদ্ধের জবাব আসে, ‘‘আবার কে উপরে উঠবে! খেলাই তো দেখছি।’’ রসিক বন্ধুকে সে যাত্রায় আর কিছু বলেননি শান্তনু।

একই ভাবে শান্তনুরও একটি গল্প শোনালেন অনিরুদ্ধ। বললেন, ‘‘হঠাৎ শুনলাম গাড়ি নিয়ে ও বেঙ্গালুরু চলে গিয়েছে। সেখানে কারও কাছে পাঁচ-সাত হাজার এলপি রেকর্ড রয়েছে। দেখভাল করার কেউ নেই। শান্তনু সেগুলো কিনে নিয়ে মুম্বই চলে এল। উদ্দেশ্য, প্রিজ়ার্ভ করবে। সঙ্গীতের প্রতি এই মর্যাদা সকলের থাকে না।’’ বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ‘কারণ’কে প্রাধান্য দেন না শান্তনু। তাঁর মতে, স্কুল বা কলেজ জীবনের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনও আদানপ্রদানের সম্পর্ক থাকে না। বললেন, ‘‘আমার সঙ্গে টোনির সম্পর্কটাও কিন্তু কিছুটা সে রকমই।’’

তবে দুই বন্ধুর মধ্যে মতানৈক্যও যথেষ্ট হয়। কিন্তু কে ঠিক বা কে ভুল, সেটাও সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে গেলে হার স্বীকার করতেও তাঁরা পিছপা হন না। দু’জনের বন্ধুরাও যেন সময়ের সঙ্গে এখন একই দলের সদস্য হয়ে উঠেছেন। অনিরুদ্ধের কথায়, ‘‘‘ডিয়ার মা’ ছবির সঙ্গীত করছে বিক্রম (ঘোষ)। শান্তনু কিন্তু নিয়মিত খোঁজখবর করে।’’ অনিরুদ্ধের মতে, শান্তনুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এখন পারিবারিক। বললেন, ‘‘ওর স্ত্রী সারদার সঙ্গে আমার স্ত্রী ইন্দ্রাণীর বন্ধুত্বও নিবিড়।’’

পেশাদার জীবনের আদানপ্রদানের বাইরে যে বন্ধুত্বের শিকড় ছড়িয়ে যায়, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় বলেই মনে করেন দু’জনে। তাই কোনও প্রজেক্টের শেষ দিনে বন্ধুকে আরও বেশি মিস্‌ করেন শান্তনু। তাঁর কথায়, ‘‘তখন মনে হয়, ইস! আরও ক’টা দিন যদি কাজটা চলত। এই খাঁটি ইচ্ছেটার মধ্যে দিয়ে কিন্তু বুঝতে পারি যে, এটাই হয়তো বন্ধুত্ব।’’

জীবনের দর্শন কখনও কখনও বন্ধুত্বের ভিত আরও মজবুত করতে পারে। এক বার সমুদ্রের ঢেউ একটি গাছের গুঁড়িকে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে তীরে। বাড়ির বারান্দা থেকে শান্তনু-অনিরুদ্ধ দেখলেন, প্রত্যেক দিন একটু একটু করে সেই গুঁড়িকে কেন্দ্র করেই যেন একটা সভ্যতা তৈরি হল। মানুষের ভিড়, বিক্রেতাদের ভিড়, বাচ্চারা খেলছে। অনিরুদ্ধ বললেন, ‘‘আবার কর্পোরেশন একদিন গাছের গুঁড়িটা কেটে নিয়ে চলেও গেল। আবার একটা শূন্যতা! আমাদের দু’জনেরই মনখারাপ হয়ে গেল।’’ অনিরুদ্ধের মতে, জীবন অনেকটা এ রকমই। ভাল-খারাপের মিশেল। সঠিক মানুষকে পাশে পেলে এগিয়ে চলার শক্তি পাওয়া যায়।

রবিবার বন্ধুত্বের উদ্‌যাপনে পরস্পরকে কী বলতে চান তাঁরা? অনিরুদ্ধ বললেন, ‘‘তিনটে শব্দবন্ধ যেন ওর জীবনে থাকে— যাও পাখি, ফেরারি মন এবং অল ইজ় ওয়েল।’’ শান্তনুর উত্তর, ‘‘ও যেমন আছে সে রকমই থাকুক, এটাই চাই। জীবনকে এই ভাবেই উপভোগ করতে থাকুক। আমি তো রয়েছিই ওর পাশে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement