ভবিষ্যৎ কি তা হলে শুধু ওটিটি প্ল্যাটফর্ম? তীব্র আশঙ্কায় হল মালিকরা।
মাথায় হাত হল মালিকদের! সাত-সাতটা বিগ বাজেট ছবি মুক্তি পাবে অনলাইনে! তাঁদের কী হবে? খাবেন কী? কর্মচারীদেরই বা খাওয়াবেন কী?
ডিজনি প্লাস হটস্টার ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সিনেমা হল খোলার আর অপেক্ষা নয়, বাড়ি বসেই সাবস্ক্রাইব করে দেখে নিন আনকোরা সিনেমা। এর মধ্যে রয়েছে অক্ষয় কুমার অভিনীত সুপার হাইপড ছবি ‘লক্ষ্মী বম্ব’ থেকে শুরু করে সুশান্তের শেষ ছবি, ‘দিল বেচারা’-ও। এর পরেই রীতিমতো ঘুম উড়েছে ‘অজন্তা’, ‘জয়া’, ‘অশোকা’ সিনেমা হল সমেত সিঙ্গল স্ক্রিনের মালিকদের।
আমাদের কি সংসার নেই?
বেহালার বহু প্রাচীন সিনেমা হল ‘অজন্তা’র কর্ণধার রতন সাহা যেমন বললেন, ‘‘এ বার আমাদের আত্মহত্যা করতে হবে। যাঁরা আজ অনলাইনে ছবি মুক্তি করে দিলেন, তাঁদের কি আমাদের কথা এক বারের জন্যও মনে পড়ল না? আমাদের কি সংসার নেই? আমাদের কর্মচারীদের মাইনে দিতে হয় না? কী করব আমরা? আমাদের কর্মচারীরাই বা কী করবে?’’ গলা কেঁপে গেল তাঁর।
সিনেমা হল মানে তো শুধু হল মালিক নন, যে মানুষটি হলে টিকিট বিক্রি করেন, অথবা যিনি ঢোকার মুখে আলো দেখান আজ তাঁরাও ‘বেকার’। সে কথা বলতে গিয়েই রতনবাবু বললেন, ‘‘প্রায় ১৫/১৬ জন কর্মচারী রয়েছেন আমাদের। এত দিন ধরে কাজ করছেন আমাদের সঙ্গে। তাঁদের প্রত্যেকেরই সংসার রয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা রয়েছে। কাউকে ৫০% বেতন দিচ্ছি। কাউকে ৭০%। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন টানব? আমাদের তো এক টাকাও রোজগার হয়নি তিন মাসে।’’
রেস্তরাঁ যদি খুলতে পারে তা হলে সিনেমা হল কেন নয়?
মঙ্গলবার ইম্পা-র কাছে নিজেদের অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন হল মালিকরা। ছিলেন অজন্তা, রূপমন্দির, উদয়ন-সহ শহরতলির সিঙ্গল স্ক্রিনের মালিকেরাও। হয় ওটিটি রিলিজ বন্ধ হোক অথবা খুলে দেওয়া হোক সিনেমা হল। রেস্তরাঁ যদি খুলতে পারে তা হলে সিনেমা হল কেন নয়? এই প্রশ্ন নিয়েই গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। ইম্পা-র পক্ষ থেকে পিয়া সেনগুপ্ত বললেন, "ওঁদের সমস্যাটা বুঝতে পারছি। ওঁদের ভয়টাও অমূলক নয়। বিশেষত সিঙ্গল স্ক্রিন হল মালিকদের সমস্যা আরও গুরুতর। কিন্তু এখানে আমাদের তো কিছুই তেমন করার নেই। যত ক্ষণ না কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কোনও নির্দেশ আসছে আমরা তো কিছু করতে পারব না।’’
তা হলে উপায়? মাল্টিপ্লেক্স সামলে নিলেও সিঙ্গল স্ক্রিন আদৌ পারবে তো? পিয়া বললেন, ‘‘সে জন্যই একটা ফান্ড তৈরি করার কথা ভাবা হচ্ছে। সিনেমা হলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবাইকেই সেখানে কিছু না কিছু অর্থ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: এক বছরে ১২টি ছবি, নতুন ইনিংসে চালিয়ে খেলছেন অর্পিতা
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে
‘‘দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে আমাদের। এর পর যখন হল খোলার কথা ঘোষণা করবে সরকার, তখন আদৌ কত জন কাজ করতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সিনেমা দেখানো না হলেও প্রতিটি সিনেমা হলের তো মাসিক একটা মেনটেন্যান্স খরচ রয়েছে, ধোয়ামোছার ব্যাপার রয়েছে। তা নেহাত কম নয়।’’ বলছিলেন ‘অশোকা’ সিনেমা হলের মালিক প্রবীর রায়। তাঁর কথায়: ‘‘গত তিন মাস ধরে নিজেদের জমানো টাকা খরচ করেই তো করতে হচ্ছে এ সব। এর পর যদি সরকারের তরফে কোনও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তা হলে সত্যিই জানি না কী করব।’’
সিনেমা হলের তো একটা নিজস্ব চার্ম রয়েছে
এ দিকে ‘ধর্মযুদ্ধ’, ‘ব্রহ্মা জানেন...’ সমেত বেশ কয়েকটি বাংলা ছবির মুক্তিও আটকে রয়েছে। সেগুলোও ওটিটিতে চলে আসবে কি না তা নিয়ে বেশ আশঙ্কায় আছেন হল মালিকেরা। যদিও শোনা যাচ্ছে, বলিউড অনলাইনে ঝুঁকলেও বাংলা ছবির পরিচালক-প্রযোজকরা কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে ছবি মুক্তিতেই আগ্রহী। কিন্তু অক্ষয়-অজয়ের ছবি হাতছাড়া মানে যে একটা বিরাট অঙ্কের ক্ষতি তা মেনে নিয়েই জয়া সিনেমা হলের মালিক মনজিৎ বণিক বললেন, ‘‘সিনেমা হলের সঙ্গে একটা বেশ বড় অংশের মানুষের পেট জড়িয়ে। আর সিনেমা হলের তো একটা নিজস্ব চার্ম রয়েছে। সবাই মিলে একসঙ্গে সিনেমা দেখা, হইহই... এ ভাবে চলতে থাকলে সত্যিই মুশকিল।’’
এই দৃশ্য কি আর ফিরবে?—প্রতীকী ছবি।
কিন্তু সিনেমা হল খুললেও আদৌ কি মানুষ আসবেন? ‘‘ফ্লাইটে তিন ঘণ্টা ট্র্যাভেল করে যদি মানুষ আসতে পারেন, বাসে গাদাগাদি করে যদি যাতায়াত করতে পারেন, তা হলে সিনেমা হলে কেন নয়? সে রকম হলে অন্য রকম সিট অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হবে। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে...’’, বক্তব্য এক হল মালিকের।
আরও পড়ুন: শুধু স্বজনপোষণে কি উপরে ওঠা যায়, পরিশ্রমটাই আসল, বললেন সুদীপা
প্রতিবাদ করলেই তো আবার রাজনীতির রং লেগে যায়
ওটিটি রিলিজ নিয়ে সরব হয়েছে আইনক্স, পিভিআর, কার্নিভ্যালের মতো মাল্টিপ্লেক্সও। তবে সিঙ্গল স্ক্রিন মালিকদের অবস্থা আরও খারাপ। শেওড়াফুলির অতি পরিচিত সিনেমা হল ‘উদয়ন’। তিন বছর আগে তা ডুয়েল স্ক্রিন হলেও গোটা ঘটনায় চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে সেই হলের মালিক পার্থসারথি দাঁ-এর। তিনি যেমন বললেন, ‘‘মিটিংয়েও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যা বুঝছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’’
প্রতিবাদের কথা উঠতেই রতনবাবুর ভয়, "প্রতিবাদ করলেই তো আবার রাজনীতির রং লেগে যায়। বিশ্বাস করুন আমরা কোনও রাজনীতিতে নেই। আমরা ব্যবসায়ী। ব্যবসা করতে চাই। খেয়েপড়ে বাঁচতে চাই।’’
সিনেমা হল খুললে মানুষ আসবেই
কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের হল মালিকেরা যখন হতাশায় ভেঙে পড়েছেন তখন খানিক উল্টো সুর শোনা গেল ‘নবীনা’ সিনেমা হলের মালিক নবীন চৌখানির গলায়। তাঁর দৃঢ় বক্তব্য, ‘‘আরে, সবাই ব্যবসা করতে এসেছে। প্রযোজক কি ব্যবসা করবেন না? উনি কত দিন লস করবেন? বাধ্য হয়েই অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে বেচছেন। আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। এ রকম করে লাভ নেই।’’ যদি মানুষ ধীরে ধীরে ওটিটি-তেই অভ্যস্ত হয়ে যায়? আর সিনেমা হলে না যায়? ভয় করছে না তাঁর? উত্তরে তাঁর জবাব, ‘‘এই যে এত অনলাইন ফুড ডেলিভারি অ্যাপ রয়েছে, তা সত্ত্বেও রেস্তরাঁ খুললে মানুষ কিন্তু এর মধ্যেও রেস্তরাঁতেই যাচ্ছে। সুতরাং সিনেমা হল খুললেই মানুষ আসবেই। তত দিন ওঁদের একটু ব্যবসা করতে দিই।’’
সিনেমা হল মালিক এবং প্রযোজকদের মধ্যে সেতুর ভূমিকা পালন করা নামজাদা ডিস্ট্রিবিউটর রাজকুমার দামানির গলাতেও শোনা গেল একই সুর। তিনি বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, অসুবিধে হচ্ছে ওঁদের। কিন্তু কতই বা ক্ষতি সহ্য করা যায়? তাই খানিক বাধ্য হয়েই এই ব্যবস্থা।’’
যদিও এরই মধ্যে খানিক স্বস্তি। এসভিএফ-এর অন্যতম কর্ণধার মহেন্দ্র সোনি মঙ্গলবার টুইট করে জানান, পুজোর সময়ে আসছে ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। এ ছাড়াও বলিউডের দুই বিগ বাজেট ছবি ‘সূর্যবংশী’ এবং ‘এইটিথ্রি’ আসবে যথাক্রমে দীপাবলি ও ক্রিসমাসে। প্রেক্ষগৃহেই সেই ছবি মুক্তির ইচ্ছা প্রযোজক এবং পরিচালকদের।
এ এক তীব্র অনিশ্চয়তায় ভরা ভবিষ্যৎ। তবে এ সবের মাঝেই অজন্তা সিনেমা হলকে নতুন করে সাজাচ্ছেন রতনবাবু। কর্মচারীদের ফাঁকা হলেই মাঝে মাঝে ডেকে নিচ্ছেন নবীন চৌখানি। যুগলের প্রেম, সদ্য বিবাহিতের হাতে হাত, সপরিবার ছুটির দিনে আমির-সলমনের সিনেমা, অথবা শাহরুখের এন্ট্রিতে জোর শিসের আওয়াজে আবার ভরুক সিনেমা হলের প্রতিটি কোণ... আপাতত এটাই চাওয়া শহরের ছোট-বড়-মাঝারি হল মালিকদের।