টলিপাড়ায় মহিলা শিল্পীরা কি সুরক্ষিত? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর-কাণ্ডের পর রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অন্য দিকে টলিপাড়ায় একাধিক নারী নিগ্রহের খবরকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে চর্চা। শোনা যাচ্ছে ইন্ডাস্ট্রির এক অভিনেত্রী, এক প্রথম সারির পরিচালকের বিরুদ্ধে রাজ্য মহিলা কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছেন। বুধবার এক প্রযোজক সমাজমাধ্যমে আর এক পরিচালকের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। প্রশ্ন উঠছে টলিপাড়া মহিলা শিল্পীদের জন্য কতটা নিরাপদ?
কয়েক বছর আগে দেশ জুড়ে সমাজমাধ্যমে শুরু হয়েছিল ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ আন্দোলন। যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে তারকারা গর্জে ওঠেন। এই ধরনের ঘটনা ঘটলে মহিলাদের একটা বড় অংশ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে বা আইনি পদক্ষেপ করতে ভয় পান। অনেক সময়ে ইচ্ছা থাকলেও সেখানে ‘প্রভাব’ খাটানোর তত্ত্বও উঠে আসে।
অনেক দিন আগের হেনস্থার ঘটনা এখনই বা সামনে আসছে কেন? ইন্ডাস্ট্রির একাংশের মতে, আরজি কর-কাণ্ডে যে ভাবে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ হচ্ছে, তা মহিলাদের নতুন করে সাহস জোগাচ্ছে। তাই তাঁরা প্রতিবাদ করছেন।
অভিনেত্রী সৌরসেনী মৈত্র এ দিক থেকে নিজেকে ‘ভাগ্যবান’ বলেই মনে করেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “এখনও পর্যন্ত আমি ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও রকম হেনস্থার শিকার হইনি।” মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে কেউ হেনস্থার শিকার হলে, তাঁর এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করা উচিত বলেই মনে করছেন সৌরসেনী। তবে তাঁর যুক্তি, “অভিযোগ সত্যি কি না, সেটাও দেখতে হবে। তথ্য সঠিক হলে নিশ্চয়ই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা উচিত।”
ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গিয়ে সৌরসেনী কি কখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন? অভিনেত্রীর উত্তর, “ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছি। রাতে শুটিং সেরে তো প্রযোজনা সংস্থার গাড়িতেই বাড়ি ফিরেছি। এখনও পর্যন্ত নিজেকে সুরক্ষিত বলেই মনে হয়েছে। তবে চারপাশে যে ভাবে একের পর এক ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে, আগামী দিনে কী হবে জানি না!” আরজি কর-কাণ্ডের পর প্রতিবাদে মিছিলে হেঁটেছিলেন সৌরসেনী। নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। তাই তিনি আদৌ সুরক্ষিত কি না, সেই আশঙ্কাও মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে অভিনেত্রীর। সৌরসেনীর প্রশ্ন, “শুধু অভিনেত্রী নয়, সমাজের যে কোনও ক্ষেত্রের মহিলারাই কি আজ সুরক্ষিত?”
টলিপাড়ায় নিজেকে সুরক্ষিতই মনে করেন অভিনেত্রী সৌমিতৃষা কুন্ডু। তবে নারী সুরক্ষার বিষয়টিকে তিনি শুধুই ইন্ডাস্ট্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে নারাজ। বললেন, “সমাজের সর্ব স্তরে নারীরা কতটা সুরক্ষিত সেটা দেখা উচিত। মহিলারা যে সুরক্ষিত নন, আরজি করের ঘটনা তো সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে।”
প্রযুক্তি ব্যবহারিক জীবনে উন্নতি ঘটালেও, নারীদের প্রতি এখনও সমাজের চিন্তাভাবনার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি বলেই মনে করেন সৌমিতৃষা। তাঁর যুক্তি, “সমাজ যদি না বদলায়, তা হলে নিজেকে অন্তত বদলে দেখি।” কখনও আক্রান্ত হলে চুপ করে না থেকে মহিলাদের এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করা উচিত বলেই জানালেন সৌমিতৃষা। তাঁর কথায়, “এক জন তো বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধুক! এক জন মুখ খুললে তা দেখে আরও দশ জন মনে জোর পাবেন।”
ইন্ডাস্ট্রিতে ১৪ বছর কাজ করছেন অভিনেত্রী মধুমিতা সরকার। তাঁর মতে, যে কোনও ইন্ডাস্ট্রিতেই মহিলাদের সঙ্গে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। মধুমিতা বললেন, “আমি কী চাইছি, তার উপরেই সবটা নির্ভর করছে।” মধুমিতা জানালেন, তিনি যাবতীয় প্রলোভন থেকে দূরে থাকাই পছন্দ করেন। তাই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে কখনও হেনস্থার শিকার হতে হয়নি। তাঁর কথায়, “আমি আমার চারপাশে সেই গণ্ডি টেনে রেখেছি বলেই আমার কাছে কেউ ঘেঁষতে পারে না।” একই সঙ্গে অভিনেত্রী যোগ করলেন, “কেউ যদি দু’বছরে মাধুরী দীক্ষিত হতে চান, তা হলে সেটা তাঁর সিদ্ধান্ত! আমি তো ১৫ বছরেও চেষ্টা করে পারিনি। যেখানে আছি, ভাল আছি।”
তবে ইন্ডাস্ট্রিতে মহিলা শিল্পীদের হেনস্থা বা কুপ্রস্তাব দেওয়া হয় না, সে কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন না মধুমিতা। কারণ বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছেও সে রকম প্রস্তাব আসে বলেই জানালেন অভিনেত্রী। মধুমিতা বললেন, “অভিনেত্রী হিসেবে আমি আজ যেখানে পৌঁছতে পারতাম, তার থেকে অনেকটাই নীচে রয়েছি। চারটে ভাল ছবিতে হয়তো সুযোগ পাব না! কিন্তু তাতে আমার কোনও দুঃখ নেই।” কারণ মধুমিতা মনে করেন, রুপোলি দুনিয়ায় তাঁর বর্তমান অবস্থান তাঁর নিজের শর্তে তৈরি। তাই তিনি সুরক্ষিতই রয়েছেন।