সঙ্গীতই বেঁধে দিয়েছিল তাঁদের পথ চলার গ্রন্থি। রাহুল ও আশা।
প্রতি বছর ২৭ জুন এলেই আশা ভোঁসলে ফিরে যান ১৯৮০-তে। সবার প্রিয় রাহুল দেব বর্মনের জন্মদিনে আশা স্মরণ করেন তাঁর আদরের ‘বাবস’-কে। ৮১ বছর আগে ১৯৩৯-এর আজকের দিনে পঞ্চমের জন্মদিন হলেও’৮০ সাল তাঁকে নবজন্ম দিয়েছিল।কোন ঘটনার সাক্ষী ১৯৮০?
‘ইয়ে লড়কি জারাসি দিওয়ানি লাগতি হ্যায়’...
আশার জীবনে রাহুল এসেছিলেন সই শিকারি হয়ে। একদিন আশা এসেছেন শচীন দেব বর্মনের স্টুডিয়োতে গান রেকর্ডিং করতে। সময়টা পাঁচের দশকের শেষ, ১৯৫৬ সাল। আশা ততদিনে ‘গুমরাহ’, ‘ওয়াক্ত’, ‘আদমি অউর ইনসান’, ‘হামরাজ’ ছবির গানের দৌলতে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। রাহুল দেব তখন বাবার সহকারী। কলেজে পড়েন।
স্টুডিয়োর কালো কাচের বাইরে থেকে আশাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছিলেন রাহুল। এই তাঁর স্বপ্নের সেই গায়িকা? অটোগ্রাফ নিতে হবে, একথা মনে হতেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। গান শেষ হওয়ার পরে স্টুডিয়োর বাইরে আসতেই গায়িকার দিকে খাতা বাড়িয়েছিলেন ভবিষ্যতের ‘রকস্টার’ সুরকার আর ডি।
সেই সই দেওয়া থেকে শুরু। সেদিনই কি রাহুলের মনে হয়েছিল, ‘ইয়ে লড়কি জারাসি দিওয়ানি লাগতি হ্যায়’...?
আরও পড়ুন: এ বার গুরুগ্রাম কাঁপাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল, এগোচ্ছে দিল্লির দিকে
কিশোর কুমার, শচীনকত্তার সঙ্গে আশা।
আশার ‘অতীত’ ছিল। দিদি লতা মঙ্গেশকরের সেক্রেটারি গণপত রাও ভোঁসলেকে বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তারপর তিন ছেলেমেয়ের মা। আর টাকার খাঁই মেটাতে না পারায় ছেলেমেয়ে-সহ আশাকে বাড়ি থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন গণপত।
অতীত অবশ্য ছিল পঞ্চমেরও। কলেজে পড়তে পড়তেই বিয়ে করেছিলেন রীতা পটেলকে। যিনি আবার রাহুলের অন্ধ অনুরাগিনী ছিলেন। শোনা কথা, রীতা নাকি বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে বিয়ে করেছিলেন পঞ্চমকে। বন্ধুদের বলেছিলেন, কিছুদিন তাঁর সঙ্গে মিশলেই আর ডি তাঁকে না বলতে পারবেন না।
সত্যিই রীতাকে সেই সময় ‘না’ বলতে পারেননি শচীনকত্তার ছেলে।
বাজি ধরে বিয়ে করা যায়, বিয়ে টেকানো যায় কি? যায় না বলেই ১৯৭০-এ (মতান্তরে ১৯৭১) বিয়ে ভেঙে গেল রাহুলের।
প্রথম দেখার পরে অবশ্য রাহুল-আশার দীর্ঘ অদর্শন। প্রায় ১০ বছর পরে ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবির গান দিয়ে আবার দু’জনের দেখা। রাহুলের সুরে ‘আজা আজা’ এবং‘ও মেরি সোনা রে’র মতো সুপারহিট গান শ্রোতারা উপহার পেয়েছিলেন আশার থেকে।
কাজ হতে থাকল। ভাল লাগাও বাড়তে থাকল। রাহুলকে ততদিনে আশা ‘বাবস’ নামে আদর করে ডাকেন। কিন্তু মনের কথা মুখ ফুটে বলতে পারেন না কেউই। তার উপর তেতো অতীত সারাক্ষণ দগ্ধাচ্ছে আশাকে। না পারছেন গণপতকে ভুলতে, না পারছেন রাহুলকে সরাতে। তার থেকেও বড় কথা তিনি রাহুলের থেকে ছ’বছরের বড়!
তাই রাহুল প্রেমে হাবুডুবু খেলে কী হবে, মা মীরা দেব বর্মনের এই সম্পর্কেই ঘোর আপত্তি।
বাবা শচীনকত্তার সুযোগ্য ছাত্র রাহুলদেব।
‘কহে দু তুমহে ইয়া চুপ রহুঁ’…
১৯৭৫-এ মিরাকল ঘটল। ‘দিওয়ার’ ছবির সুরকার আর ডি। তাঁর সুরে স্টুডিয়োতে রেকর্ডিং হচ্ছে ‘কহে দু তুমহে ইয়া চুপ রহুঁ’ গান। রেকর্ডিং শেষ। রুম থেকে বেরোতেই আশার মুখোমুখি পঞ্চম। চোখে প্রশ্ন, এই গানের পরেও মুখে কিছু বলতে হবে? আশার পক্ষে আর ফেরানো সম্ভব হয়নি রাহুলকে।নিজের অতীত জানিয়েছিলেন আশা। সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন সুরকার। তারপর তাঁর স্বপ্নের গায়িকার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘‘ভাল-মন্দ সব নিয়ে তোমায় গ্রহণ করব। কোনওদিন একটা প্রশ্ন করব না। আর না বোল না।’’
তারও পাঁচ বছর পরে। ১৯৮০-তে বিয়ে হল সুর-তাল-ছন্দ আশ্রয় করে বেঁচে থাকা দুই শিল্পীর। রাহুল-আশা গানের দুনিয়ায় প্রথম তারকা দম্পতি, যাঁরা একসঙ্গে ১৪ বছর বাঁধা ছিলেন গান দিয়ে।
‘তোমায় কোনওদিন ছেড়ে যাব না...ইয়ে ওয়াদা রহা’
রাহুল এই শপথ আশাকে করলেও গায়িকার মনে প্রচণ্ড ভয়। গণপতের থেকে পাওয়া অসম্মান কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারেন না। তার উপর বছর ছ’য়েকের বড় তিনি রাহুলের থেকে। শাশুড়ি মা তাই খুশি নন এই বিয়েতে। বিয়ের দিনও নিন্দুকে মুখ মচকেছে, ‘‘তিন সন্তানের মাকে বিয়ে করল রাহুল! শেষ পর্যন্ত টিকলে হয়।’’ফুলশয্যায় খুব ভয়ে ভয়ে সেকথা আদরের ‘বাবস’কে জানিয়ে আশার প্রশ্ন ছিল, ‘‘সবাই যা বলছে তেমনটা হবে না তো? তুমিও আমায় ছেড়ে চলে যাবে না তো?’’
আরও পড়ুন: লাদাখের পি পি ১৪-র কাছে ফের ভারতীয় এলাকা দখল করল চিন
সেদিন নতুন বউয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রাহুল আশ্বস্ত করেছিলেন কী বলে?
‘দুনিয়া ছাড়লেও আমি তোমায় কোনওদিন ছেড়ে যাব না...ইয়ে ওয়াদা রহা’...।