কৈশোরেই অনাথ। স্কুলের পাঠ শেষ দশম শ্রেণিতেই। অন্নসংস্থানের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করতেন প্রসাধনী। তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ বহু তাবড় অভিনেতা। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক দশক বলিউডে কাটিয়েও প্রত্যাশিত সুনাম বা পরিচিতি পাননি অরশদ ওয়ারসী।
তাঁর জন্ম ১৯৬৮ সালের ১৯ এপ্রিল, মুম্বইয়ে। পড়তেন নাসিকের একটি আবাসিক স্কুলে। তিনি যখন স্কুলের ছাত্র, ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাবা। ২ বছর পরে মা মারা যান কিডনি বিকল হয়ে। স্কুলের গণ্ডি পেরনোর আগেই দশম শ্রেণিতে শেষ পড়াশোনা।
অল্প বয়সেই মাথার উপর থেকে অভিভাবকের ছায়া সরে যাওয়ায় অরশদের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৭ বছর বয়সে বাড়ি বাড়ি প্রসাধনী বিক্রি করে উপার্জন আরম্ভ করেন। এর পর কিছু দিন কাজ করেন ফটো স্টুডিয়োর ল্যাবরেটরিতে। জর্জরিত জীবনের একমাত্র আনন্দ ছিল হিন্দি সিনেমা। বিশেষ করে সিনেমার দৃশ্যে নাচ দেখতে খুব ভালবাসতেন। যে কোনও নাচ চটজলদি তুলেও ফেলতেন।
একটি ইংরেজি নাটকের দলে কয়েক দিন কাজ করার পরে সুযোগ পেলেন আকবর সামির নাচের দলে। ১৯৮৭ সালের দু’টি ছবি ‘ঠিকানা’ এবং মহেশ ভট্টের ‘কাশ’-এ কোরিয়োগ্রাফি দলে ছিলেন অরশদ। পরের ৫ বছরের মধ্যে দেশে বিদেশে দু’টি নামী নাচের প্রতিযোগিতায় জয়ী হন তিনি।
পুরস্কারমূল্য দিয়ে নিজের একটি ডান্স স্টুডিয়ো এবং নাচের দল শুরু করেন তিনি। ১৯৯৩ সালে কোরিয়োগ্রাফি করেন ‘রূপ কি রানি চোরোঁ কা রাজা’-র টাইটেল ট্র্যাকের। এই সময়ে তাঁকে অভিনয়ের সুযোগ দেন জয়া বচ্চন। পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তাঁর কেরিয়ার তৈরির পিছনে জয়ার অবদানের কথা। বরাবর তাঁকে কেরিয়ারের পথে সাহায্য করেছেন জয়া।
পর্দায় তাঁর প্রথম আবির্ভাব ১৯৮৯ সালে। নাচের সিকোয়েন্সে একটি ছোট্ট ভূমিকায় তাঁকে দেখা গিয়েছিল ‘আগ সে খেলেঙ্গে’ ছবিতে। তবে পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা হিসেবে ওয়ারসীর প্রথম ছবি অমিতাভ বচ্চনের প্রযোজনা সংস্থার ‘তেরে মেরে সপনে’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৬ সালে।
এর পরের কয়েক বছরে ‘বেতাবি’, ‘হিরো হিন্দুস্তানি’, ‘হোগি প্যায়ার কে জিত’, ‘ত্রিশক্তি’, ‘মুঝে মেরি বিবি সে বঁচাও’-সহ বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন। কিন্তু কোনও ছবিতেই তিনি দর্শকদের পছন্দের প্রথম সারিতে পৌঁছতে পারেননি। তার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় ২০০৩ অবধি। সে বছর মুক্তি পায় ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’।
বক্স অফিসে সুপারডুপার হিট এই ছবির দৌলতে ওয়ারসী হয়ে ওঠেন ইন্ডাস্ট্রির ‘সার্কিট’। সঞ্জয় দত্ত এবং অরশদ ওয়ারসীর যুগলবন্দি ছিল এই ছবির সাফল্যের মূল অনুঘটক। ‘সার্কিট’-এর ভূমিকায় তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়ের পরে বেশ কয়েকটি সুযোগ আসে অরশদের কাছে।
‘হালচাল’, ‘কুছ মিঠা হো যায়ে’, ‘সলাম নমস্তে’, ‘গোলমাল’-এর মতো ছবিগুলিতে সে সময় অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু মুন্নাভাইয়ের মতো সাফল্য পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল এর দ্বিতীয় অংশ ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ অবধি। রাজকুমার হিরানির পরিচালনায় এই ছবিও বাজিমাত করে বক্স অফিসে।
নায়ক হওয়ার দৌড়ে কোনও দিন শামিল হননি অরশাদ। কিন্তু বলিউডের সফল পার্শ্ব অভিনেতাদের মধ্যেও আসতে পারেননি। থেকে গিয়েছেন সহ অভিনেতা হয়েই। তাঁর একক অভিনয়ে কোনও সিনেমা সুপারহিট হয়েছে, নেই এমন নজিরও।
তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য বাকি ছবিগুলি হল ‘হল্লা বোল’, ‘ক্রেজি ফোর’, ‘গোলমাল রিটার্নস’, ‘ইশকিয়া’, ‘হম তুম অউর গোস্ট’, ‘গোলমাল থ্রি’, ‘ডবল ধামাল’, ‘জিলা গাজিয়াবাদ’, ‘জলি এল এল বি’, ‘দেড় ইশকিয়া’, ‘ওয়েলকাম টু করাচি’, ‘গোলমাল এগেইন’, ‘দ্য লেজেন্ড অব মাইকেল মিশ্র’ এবং ‘টোটাল ধামাল’।
অভিনয় করেছেন ছোট পর্দাতেও। ‘করিশ্মা-দ্য মিরাকলস অব ডেস্টিনি’ সিরিয়ালে তিনি দীর্ঘদিন অভিনয় করেছেন করিশ্মা কপূরের সঙ্গে। সঞ্চালকের কাজ করেছেন ‘বিগ বস’, ‘জরা নাচকে দিখা’-র মতো শো। কমেডি সিনেমাতে বেশি নজর টানলেও অরশদ নিজে নিজেকে দেখতে পছন্দ করেন সিরিয়াস ভূমিকায়।
তবে হিন্দি ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি যে বেশি ব্যবহৃত হননি, সে প্রসঙ্গে সহমত নাসিরুদ্দিন শাহ, বিদ্যা বালন, বোমান ইরানি-সহ বহু নামী অভিনেতা। তাঁরা মনে করেন, অরশদের প্রতিভাকে সে ভাবে কাজে লাগাতে পারেননি পরিচালকরা। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি যে নাচের দিক দিয়েও জুড়িহীন, সে কথাও স্বীকার করেছেন ইন্ডাস্ট্রির বহু নামী ব্যক্তিত্বই।
নাচের সূত্রেই হবু জীবনসঙ্গিনীকে পেয়েছিলেন অরশদ। কেরিয়ারের শুরুতে ১৯৯১ সালে তিনি বিচারক হয়ে গিয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে একটি নাচের প্রতিযোগিতায়। সেখানে প্রতিযোগীদের মধ্যে ছিলেন সেন্ট অ্যান্ড্রুজ কলেজের ছাত্রী মারিয়া গোরেট্টি। তাঁর নাচ এবং হাসি দেখে মুগ্ধ হন অরশদ।
আলাপ আরও গভীর করতে মারিয়াকে তাঁর নাচের দল যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন অরশদ। কিন্তু শুনেই তা নাকচ করেন মারিয়া। প্রত্যাখ্যাত হয়েও হাল ছাড়েননি অরশদ। মারিয়ার মন পাওয়ার চেষ্টা তিনি জারি রাখেন। প্রাথমিক টালবাহানার পরে মারিয়াও রাজি হন অরশদের নাচের দলে যোগ দিতে।
দু’জনে দু’জনের সঙ্গ উপভোগ করার পরে এক দিন মারিয়াকে প্রোপোজ করেন অরশদ। কিন্তু উত্তরে মারিয়া প্রত্যাখ্যান করেন তাঁর প্রেম। অরশদ বুঝতে পারছিলেন মারিয়া তাঁকে ভালবাসেন। কিন্তু মুখে স্বীকার করছেন না। সেটা করানোর জন্য বুদ্ধি বার করলেন অরশদ। দুবাইয়ে নাচের শো করতে গিয়ে সুযোগ বুঝে মারিয়ার ঠান্ডা পানীয়ে সামান্য বিয়ার মিশিয়ে দিলেন।
সুরায় অনভ্যস্ত মারিয়া নেশার ঘোরে স্বীকার করেন তিনি অরশদকে ভালবাসেন। তাঁকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। এর পর আর অরশদকে পায় কে! এখনও এই পুরনো স্মৃতি নিয়ে দু’জনে হাসাহাসি করেন। তবে অরশদকে প্রথমে জামাই হিসেবে মেনে নেননি মারিয়ার বাবা মা। অরশদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে তাঁরা অবশ্য আর আপত্তি করেননি।
৬ বছর প্রেমপর্বের পরে ১৯৯৯ সালে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে বিয়ে করেন অরশদ ওয়ারসী এবং মারিয়া গোরেট্টি। প্রথমে গির্জায় গিয়ে বিয়ে, তার পর নিকাহ। ছেলে জেক এবং মেয়ে জেন জো-কে নিয়ে তাঁদের জমজমাট সংসার। বছরে অন্তত দু’বার সপরিবার ছুটি কাটানো তাঁদের চাই-ই চাই। এ ছাড়াও ইচ্ছে হলেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন অরশদ।
তবে সুখী দাম্পত্যের সুরও এক বার কেটেছিল। সে বার অরশদ নিজের প্রোডাকশন হাউস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কাজের চাপে সময় দিতে পারছিলেন না পরিবারকে। এই নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল দাম্পত্য বিবাদ। প্রায় ৯ মাস টানাপড়েন অবশেষে মিটে যায়। অরশদ ঠিক করেছেন আপাতত আর ছবি প্রযোজনা নয়। বরং তিনি উপভোগ করবেন স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গ।