(বাঁ দিকে) অনুপম রায়। সৃজিত মুখোপাধ্যায় (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
একসঙ্গে বাংলা সিনেমায় হাতেখড়ি তাঁদের দু’জনের। সালটা ২০১০। দেখতে দেখতে ১৩ বছর পার করে ফেলেছেন তাঁরা। সময়ের সঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে তাঁদের কেরিয়ারগ্রাফ। এক জনের নামের পাশে জুড়েছে ইন্ডাস্ট্রির ‘ফার্স্ট বয়’-এর তকমা। অন্য জন তাঁর সুর ও লেখার মুনশিয়ানায় বুঁদ করেছেন এক প্রজন্মকে। একসঙ্গে পর পর কাজ করেছেন দু’জনেই। এ বার দশ নম্বর ছবিতে জুটিবদ্ধ হলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় ও অনুপম রায়। এ বার পুজোয় আসতে চলেছে ‘দশম অবতার’। তার আগে সঙ্গীতশিল্পীর মুখোমুখি ‘আনন্দবাজার অনলাইন’।
প্রশ্ন: অতীত বলছে, পুজোতে অনুপম-সৃজিত জুটি মানেই হিট। কোন ফর্মুলায় সাফল্য আসছে?
অনুপম: হ্যাঁ, এখনও অবধি ব্যর্থ হয়নি। আমি এত গান বানাই, সব গান তো জনপ্রিয় হয় না। সৃজিতদার সঙ্গে যখন ‘অটোগ্রাফ’ করি, তখন সবটা নতুন ছিল। দর্শকদের নতুন কিছু স্বাদ দিতে পেরেছিলাম আমরা। সে ছবির গল্প হোক কিংবা গান। তার পর ‘২২শে শ্রাবণ’, ‘চতুষ্কোণ’, ‘উমা’— সবই পুজোর রিলিজ়। শেষ আমি আর সৃজিতদা একসঙ্গে ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ করেছিলাম। বলতে পারেন, সব অ্যালবামের গানই হিট। কিন্তু সাফল্য কী করে এল, সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।
প্রশ্ন: সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এতগুলো ছবি করেছেন। কখনও মনে হয়েছে সিনেমাকে ছাপিয়ে গিয়েছে আপনার গান?
অনুপম: আমার মনে হয় না, এটা নতুন কোনও ব্যাপার। যুগ যুগ ধরে এমন অনেক সময়ই হয়। আসলে গানের অভিঘাত মারাত্মক। একটা গান যদি মানুষের মন ছুঁয়ে যায়, তা হলে বহু বছর বেঁচে থাকে। সিনেমা একটা জাহাজের মতো। একটা ভেসেল যেমন অনেক কিছু নিয়ে বন্দরে পৌঁছয়, তেমন ভাবেই কাজ করে সিনেমা। তাতে গান থাকে, অভিনয় থাকে।
প্রশ্ন: আপনার এই ধারণার সঙ্গে সৃজিত কি একমত? কী মনে হয়?
অনুপম: আমার মনে হয় সৃজিতদাও সহমত হবেন। একটা গান সফল হলে তার আয়ু হয় অনেকটা। দেব আনন্দের ছবির নাম ভুলে গেলেও গান কিন্তু ভোলেন না মানুষ।
একটা গান যদি মানুষের মন ছুঁয়ে যায়, তা হলে বহু বছর বেঁচে থাকে, বলছেন অনুপম।
প্রশ্ন: ‘দশম অবতার’-এর গানে নতুন কী পাবেন দর্শক?
অনুপম: ব্যালাড তৈরি করতে ভালবাসি। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’, ‘বোবা টানেল’, ‘একবার বল’। এই ধরনের গান আমি খুব সহজে বানাতে পারি। কলম ধরলে এই ধরনের গান বেরোয়। তেমনই একটা ব্যালাড এই ছবিতেও রেখেছি। গানটি আমার কণ্ঠেই রয়েছে। তবে গানটি রেকর্ডিংয়ের এক অভিনব অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। এই গানটা ইউরোপে ম্যাসিডোনিয়ায় গিয়ে সেখানকার বিখ্যাত অর্কেস্ট্রার সঙ্গে রেকর্ড করা হয়েছে। আমার ১৩ বছরের সঙ্গীত জীবনে এটা প্রথম। একটা রক গান রয়েছে রূপম ইসলামের গাওয়া। আরও একটি প্রেমের গান রয়েছে যেটা গেয়েছেন অরিজিৎ সিংহ ও শ্রেয়া ঘোষাল। গানটা প্রেমের গান হলেও অনেক ওঠাপড়া আছে। ওদের ডুয়েট হিট হবে বলেই আশা করছি। চতুর্থ গানটি শ্লোক বা স্তোত্র, স্তোত্রে প্রথম বার সুর করলাম। বিষ্ণুর যে দশ অবতারের স্তোত্র আছে, সেটিতে সুর করার সাহস দেখিয়েছি। গানটি গেয়েছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ওঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
প্রশ্ন: আচ্ছা বাংলা সিনেমার গান কি ছকের বাইরে বেরোতে পারে না?
অনুপম: অনেক সময় এটা করা হয়। যখন ‘অটোগ্রাফ’ মুক্তি পায়, তখন আমাদের থেকে তেমন কোনও আশা ছিল না। সে বছর মুক্তি পায় দেব ও জিতের ‘দুই পৃথিবী’। ছবির সুর করেছিলেন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ওই ছবির গানের সুর-ধরন একেবারেই ছকে বাঁধা ছিল। আমরা এসে নতুন ধরনের ফর্মুলার দিলাম। সেটা হিট করতেই ‘২২শে শ্রাবণ’। এ বার ২০২৩ সালে ‘দশম অবতার’ পুরনো ভিতের উপর দাঁড়িয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রশ্ন: ‘দশম অবতার’ সৃজিতের সঙ্গে দশ নম্বর ছবি আপনার। পরিচালক আপনাকে ভরসা করেন না কি কাজে নাক গলান?
অনুপম: (একটু ভেবে) প্রচুর ইনপুট থাকে সৃজিতদার। ‘উমা’, ‘জুলফিকর’-এর সময়টা একটু কমেছিল এগুলো। কারণ তখন আরও বেশি ব্যস্ত ছিল। তবে এ বার জাঁকিয়ে বসেছে একেবারে। আসলে আমরা ভাবনা তো আমার একার নয়। আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরও অনেক রকমের খুঁটিনাটি অবদান থাকে। এর পর আসে পরিচালকের ভাবনা। সৃজিতদার সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গির তফাত আছে। কিন্তু আগে ছেলেমানুষি বেশি ছিল। তাই ঝগড়া হত খুব। আমি তখন মুখের উপর মানা করে দিতাম। কিন্তু আমাকে ওর কথা মতো কাজ করতেই হত। কারণ, ও পরিচালক। ও যেটা বলবে সেটাই হবে। এখন অবশ্য ঝগড়া হয় না, মধ্যপন্থা খুঁজে নিয়েছি আমরা। তবে সৃজিতদার নতুন কিছু করার ইচ্ছে রয়েছে, যেটা অন্যদের নেই।
প্রশ্ন: সৃজিত ভাল গান বোঝেন না কি গান ভালবাসেন?
অনুপম: কঠিন প্রশ্ন। ভাল যে বাসেন, সেটা ওঁর ছবি দেখলে বোঝা যায়। আমার বিশ্বাস, এক দিন নিশ্চয়ই ও সুরও দেবে। আমি চাই ও করুক।
প্রশ্ন: যখন সুর দেন বা লেখেন তখন অ্যালবামের সেরা গানটা কি নিজের জন্য সরিয়ে রাখেন? না কি এ ক্ষেত্রে আপনি উদার?
অনুপম: আমি বিশ্বাস করি, যা গান লিখছি সব নিজের জন্য। এক বারও আমি এটা ভাবি না যে অমুকের জন্য লিখছি। যখন সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করি, তখন নিজের সঙ্গে নিজের একটা যুদ্ধ চলতে থাকে। (মুচকি হেসে) আমি পারলে মহিলা কণ্ঠটাও নিজে গাই। ছবিতে যখন কাজ করছি তখন চিত্রনাট্য-পরিস্থিতি অনুযায়ী শিল্পী নির্বাচন করতে হয়। আমার সুরে প্রত্যেকই গেয়েছেন এখানে। ভবিষ্যতেও গাইবেন।
প্রশ্ন: অরিজিৎ সিংহকে সঙ্গীত জগতের ‘গোট’ (গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম) বলে থাকেন অনেকে। আপনিও কি তাই মনে করেন?
অনুপম: (কিছুটা সময় নিয়ে) অরিজিৎ খুবই গুণী। ও যে ভাবে গানটা দেখে, সেটা ভাল লাগে। ও নিজের পারফর্ম্যান্স যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে, তা বৈগ্রহিক। ও আমার অনেক গান গেয়েছে। তবে একটু সময় নেয় গাইতে। এত ব্যস্ত থাকে ও, গেয়ে পাঠানোর জন্য বলতেও একটু সঙ্কোচ হয়। তবে কোনও তুলনা করতে চাই না। ‘গোট’ কি না জানি না। অরিজিৎ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক জন সঙ্গীতশিল্পী। ওকে আমাদের প্রয়োজন, সেটা হলফ করে বলতে পারি। কিশোর কুমার, রফি, লতা মঙ্গেশকর— সকলকেই সঙ্গীতের দুনিয়ায় প্রয়োজন। কে মহান কিংবা কে বেশি ভাল বলটা ঠিক নয়।
গায়ক অরিজিৎ সম্পর্কে কী বললেন অনুপম?
প্রশ্ন: অরিজিৎকে নাগালে পাওয়া বেশ শক্ত। এই ছবির গানের জন্য কত বার ফোন করতে হয়েছে?
অনুপম: জুন মাসে প্রথম ফোন করি। তখন আশ্বাস দিয়েছিল, গাইবে। সেটা আগে জেনে নেওয়া ভাল। তার পর জুলাই, অগস্ট পার করে অবশেষে সেপ্টেম্বরে গানটা গেয়ে পাঠিয়েছে। সেটার কাজ এখন চলছে। আমরা সবই জানতাম ওই গানটা শেষেই আসবে। ও খুব বুদ্ধিমান ছেলে। কোন সঙ্গীত পরিচালক কোনটা পছন্দ করে সেটা ও খুব সহজে ধরতে পারে। সে ভাবেই গায়। আমি খুবই খুশি গান শুনে।
প্রশ্ন: গায়ক অনুপমের কখনও ঈর্ষা হয় অরিজিৎ সিংহকে?
অনুপম রায়: না না, কখনওই হয় না। আসলে আমাদের দু’জনের লক্ষ্যটা আলাদা। ও যেটাকে লক্ষ্য করেছে, সেটা কখনওই আমার লক্ষ্য ছিল না। বাংলার ছেলে হয়ে যে খ্যাতি ওর, সেটা আরও বাড়ুক মন থেকে চাই।
প্রশ্ন: সৃজিতের ছবিগুলোতে এত গানের মধ্যে কোনও একটা গান কি সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে বলে হয়?
অনুপম: সেটা দর্শক ভাল বলতে পারবেন। তবে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’-কে কেউই হারাতে পারবে না কোনও দিন। আমার যখন শশ্মানে গাড়ি যাবে ওই গানটাই বাজবে। ওই গানটা আজীবন থাকবে। তবে আমি আমার গানের মধ্যে বাছবিচার করতে পারি না।
প্রশ্ন: এত বাংলা ছবিতে কাজ করার পর কোন ছবিতে কাজ করার সময় সব থেকে অন্য রকম লেগেছিল?
অনুপম: ‘২২শে শ্রাবণ’ ছবিটা করার সময় অভিজ্ঞতা একেবারে অন্য রকম ছিল। কারণ, চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এই ইন্ডাস্ট্রিতে টাকাপয়সা কী ভাবে রোজগার করতে হয়, তা বুঝতে পারছিলাম না। কারণ সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে পারিশ্রমিক খুব সামান্য। তার আগে আমার একটা অফিস জীবন ছিল। তাই সকালে উঠে বুঝতে পারতাম না সারা দিন কী করব। ছবিতে একটাই গান, বাছাই হয়ে গিয়েছে। যখন কলকাতায় ফিরেছি, সেটা ছিল মার্চ-এপ্রিল মাস। সেই সময় অনুষ্ঠানও নেই। একই গানের মিক্সিং বার বার শুনতাম। তার পর বহু পুজো এসেছে, পাঁচ-ছ’টা ছবি মুক্তি পেয়েছে। এ বছর আবার কাকতালীয় ভাবে পুজোয় আমার একটাই ছবি মুক্তি পাচ্ছে।
বাঙালিরা কিন্তু কখনও সাফল্যের কথা ভেবে কিছু করেননি: অনুপম
প্রশ্ন: আপনি কি বলিউডে একটু কম চেষ্টা করছেন, না কি টলিউডে কাজ করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ?
অনুপম: মুম্বইতে কাজ করছি সম্প্রতি। তবে সেটা পার্শ্বসঙ্গীতের কাজ। সেটা করে তো প্রচারের আলোয় আসা যায় না। এ ছাড়াও হিন্দি ছবির ধারা বদলে গিয়েছে, ওটিটির রমরমা। আর ওটিটির ছবিতে আমার জায়গা নেই। কারণ, সেখানকার ছবিতে গান নেই। আজকে ‘জওয়ান’ বা ‘পাঠান’-এর মতো ছবিতে কেউ তো ডাকছে না আমাকে। আর আমি চেষ্টা করছি না তেমন নয়, কিন্তু ডাক পাচ্ছি কই?
প্রশ্ন: সিনেমা থেকে গান, সবেতেই এখন দক্ষিণের দাপট চলছে। বাংলার এক সময় তেমন দখল ছিল। কিন্তু এখন কেন পিছিয়ে পড়ছি কেন আমরা?
অনুপম: আমাদের সঙ্গীতের ধরন আলাদা। বাঙালিরা কিন্তু কখনও সাফল্যের কথা ভেবে কিছু করেননি। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহেরা কেউই শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য সিনেমা করেননি। আসলে সময়ের সঙ্গে রাজনীতি ও সমাজে এমন বদল ঘটেছে যে এই রুচিশীল দর্শকের সংখ্যা দিন দিন কমেছে। এখন যে ধরনের গান জনপ্রিয় হচ্ছে, সেগুলো ভীষণ রকম বিনোদনের কথা মাথায় রেখেই নির্মিত। আমাদের বাঙালিদের গানও জনপ্রিয়। তবে সেটা ভারতের কিছু মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ‘কেজিএফ’ কিংবা ‘আরআরআর’-এর মতো ছবির গান হয়তো বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু সেই দর্শককেও যে আমাদেরও যে তুষ্ট করতে হবে তেমনটা নয়। দক্ষিণী গানের কথা কী! আর হিন্দি গানের কথাই বা কী! বাঙালির সংস্কৃতি দক্ষিণের চেয়ে আলাদা। রুচির তফাত রয়েছে।
প্রশ্ন: শিল্পী হিসাবে কী মনে হয়, পুজোর গান হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী কারা?
অনুপম: আসলে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। একটা স্বতন্ত্র গানকে দাঁড় করানোর মতো কাঠামো নেই আমাদের। যদিও ছবির গানের ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যায়। একটা শিল্পী গান বানানোর পর লক্ষ্য থাকে সেটাকে কোনও ছবিতে যদি ঢোকানো যায়। কারণ, অ্যালবামের গান কেউ শোনেন না। একটা ছবি মাঝারি মানের হলেও সেটা দর্শকের কাছে পৌঁছয়। অ্যালবাম বা একক ক্ষেত্রে তা কিন্তু হয় না। তবে এ সবের উপরে যেটা হল— চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদন। আগে বছরে এত গান বেরোত না। তাই পুজোতে শিল্পীদের গান শোনার জন্য মুখিয়ে থাকতেন দর্শক। এখন সারা বছর এত গান যে অপেক্ষাটাই চলে গিয়েছে। তবে আমার মনে হয়, যুগের সঙ্গে সব হাওয়াই বদলেছে। এখন হয়তো পুজোর গান বলতে এই সিনেমার গানকে বোঝানো হয়। হয়তো আগামী সময়ে এই রীতিও ভেঙে যাবে।
প্রশ্ন: পুজোয় এ বার তা হলে কোনও একক নয়?
অনুপম রায়: নাহ্, আর অন্য কোনও গান নয়। শুধু ‘দশম অবতার’ শুনলেই হবে।