Miss Shefali

নিভে গেল সন্ধ্যাতারা

চলে গেলেন কসমোপলিটন কলকাতার প্রতীক ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালি

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:২৯
Share:

ডান্স ফ্লোরে শেফালি

তখনও সব ধরনের নারীচরিত্রে জুতসই অভিনেত্রী পাওয়াটা মুখের কথা ছিল না। সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে মিস শেফালির চরিত্রটা সে যুগের নিরিখে খানিক বিতর্কিত। তখনও যৌনতা নিয়ে যথেষ্ট জড়তা রয়েছে টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। আর ক্যামেরার সামনে অসঙ্কোচ যৌনতার বহিঃপ্রকাশ নিয়েও সচেতন ছিলেন অনেক অভিনেত্রীই। সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের ভিত্তিতে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে দেহোপজীবিনী এক নারী, যিনি আবার নার্সের কাজও করেন, এমন ভূমিকায় অভিনয় করতে কে আর রাজি হতেন! এই নিয়ে সত্যজিৎ রায়েরও কিছুটা দুশ্চিন্তা ছিল, বলছিলেন তাঁর পুত্র সন্দীপ রায়। তাঁর কথায়, ‘‘ঠিক কে মিস শেফালিকে দিয়ে রোলটা করানোর কথা বলেছিলেন, তা এখন আর মনে পড়ে না। তবে বাবার তা মনে ধরেছিল। এবং ওঁর সঙ্গে দেখা করেই বাবা সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত করে ফেলেন। মনে আছে, শেফালিদেবীর স্ক্রিনটেস্টও বাবা নেননি।’’

Advertisement

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-র সেই দৃশ্যের শুটিং যে একেবারে মসৃণ ভাবে হয়েছিল, তা মনে আছে সন্দীপ কিংবা ওই দৃশ্যে শেফালির সহ-অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের। আদর্শবাদী মেধাবী রাজনীতিমনস্ক সত্তরের তরুণের সরলতা ভাঙার সেই দৃশ্য। তার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে কলকাতার বণিক সভ্যতার শূন্য মরুভূমি। নারীদেহের পণ্যায়নসর্বস্ব এক পাপের জগৎও। ‘সীমাবদ্ধ’র শেফালিকে তাঁর নিজের ভূমিকাতেই বেছেছিলেন সত্যজিৎ। বরুণ চন্দের মনে আছে, সেটা বোধহয় ফারপোজ়ের লিডো রুম। ‘‘রিংকু (শর্মিলা ঠাকুর) ওর বাচ্চাদের নিয়ে পাশেই ওবেরয় গ্র্যান্ডে উঠেছিলেন। পরের দিন ওদের ফেরার ফ্লাইট। শুটিং শেষ হতে ভোর হয়ে গেল।’’ শেফালি ও বরুণ দু’জনেই কাঠ বাঙাল। প্রাণ খুলে বাঙাল ভাষায় কথাও বলতেন।

Advertisement

ফ্লোরের আগুন

‘সীমাবদ্ধ’র শেফালি নিছকই ‘সেক্স-সিম্বল’ নন। নৃত্যশিল্পীর দক্ষতা বা উৎকর্ষে ভরপুর এক দৃপ্ত নারীত্বেরও প্রতীক। আবার কল্লোলিনীর কসমোপলিটন ধারারও প্রতীক এই শেফালিই। বোধহয় দেওয়ালে পিঠ না ঠেকলে নতুন রাস্তার খেই মেলে না। নারায়ণগঞ্জের নিম্নবিত্ত উদ্বাস্তু ঘরের আরতি দাস জীবিকার অন্বেষণে তরি ভেড়ালেন নতুন দিগন্তে। তিনিই ভাবীকালের মিস শেফালি। উত্তর কলকাতার আহিরীটোলার বাসা থেকে চাঁদনি চকে একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে পরিচারিকার কাজ করতে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা মেয়েটি। সেটাই খুলে দিল নতুন উড়ানের রাস্তা। বাড়িতে এন্তার নাচগানের পার্টি আড়াল থেকে দেখতে দেখতেই শেফালির নাচের তালিম শুরু হয়েছিল। আমবাঙালি শেফালির আগুনের হলকার মর্ম বুঝেছে অনেক পরে। তত দিনে ফারপোজ়ে শেফালির সাম্বা, ওয়েস্টার্ন, ব্লুজ়, হাওয়াইয়ানের মাদকতায় মজে গিয়েছে উচ্চকোটির কলকাতা। উত্তমকুমারের সঙ্গে শেফালির আলাপ ফারপোজ়েই। ক্রমশ মহানায়কের ময়রা স্ট্রিটের বাড়ির আড্ডায় চেনা মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। উত্তম তখন তাঁর ‘দাদা’।

শেষ বয়সে শেফালি

ফারপোজ় থেকে ওবেরয় গ্র্যান্ড, মোক্যাম্বো, ট্রিঙ্কাজ় বা ব্লু ফক্সে নাচে-গানে-আড্ডায় তখন শেফালির সৌরভ। ঘুরেফিরে ওই সব তল্লাটেই আড্ডায় মজতেন সে দিনের উষা আইয়ার (উত্থুপ), প্যাম ক্রেন, শেফালিরা। আজকের মোক্যাম্বোর কর্তা নীতিন কোঠারি বা ট্রিঙ্কাজ়ের আনন্দ পুরীর মতো পার্ক স্ট্রিট পাড়ার কয়েক জন প্রবীণ সেই সোনাঝরা দিনের সাক্ষী। পরে শেফালির আত্মকথন ‘সন্ধ্যারাতের শেফালি’র অনুলিখন যাঁর হাতে, সেই শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখেও, ‘‘তথাকথিত ডিগ্রিহীন শেফালির আদবকায়দা বা এটিকেটে কিন্তু খুঁত নেই। ইংরেজি গড়গড়িয়ে বলতে পারতেন না। তায় কয়েকটা শব্দের উচ্চারণ একদম খাঁটি সাহেবি।’’

থিয়েটারের অক্সিজেন

একটা সময়ে উত্তর কলকাতার থিয়েটারপাড়ায় ধঁুকতে থাকা সারকারিনা, বিশ্বরূপাকে অক্সিজেন জোগানোর ভার নিতে হয়েছিল শেফালিকে। তাঁর চলে যাওয়ার খবর পেয়েই সোদপুরে শেফালির ভাইঝি আলভিনাকে ফোন করেন অভিনেত্রী পাপিয়া অধিকারী। তাঁর সহ-অভিনেতা ধীমান চক্রবর্তীর মনে আছে, ‘‘শেফালিকে দেখতেই তখন সাহেব ও মেমসাহেবরা বিশ্বরূপায় আসতেন।’’ শেফালির ভিতরে বরাবর বেঁচে ছিল একজন মাটির মানুষও। ফারপোজ়ের হেঁশেলে ঘরোয়া রান্নার আবদার করতেন শেফদের কাছে। আবার বিশ্বরূপার গ্রিনরুমে বসে পেটপুরে শুঁটকি মাছের স্বাদ নিতেন।

তবু কোথাও হয়তো ভারসাম্য বজায় থাকেনি শেফালির জীবনে। উষা উত্থুপ দুঃখ করছিলেন, ‘‘শেষ জীবনে খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। কেন হবে এটা...’’ মুনমুন সেনের মনে হচ্ছে, ‘‘কলকাতাটা ক্রমশ বোরিং হয়ে যাচ্ছে। না বাঙালি, না আমেরিকান। ডিজিটাল কলকাতা। শেফালির চলে যাওয়াও সেই দুঃখটাই খুঁচিয়ে তুলছে।’’ শেফালির ভাইঝি আলভিনার সারা জীবনের সঞ্চয় তাঁর ‘মামের’ ভালবাসা। তবে আক্ষেপও রয়েছে। বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর শোকবার্তার কথা শুনেছি। আমাদের সঙ্গে কেউ কথা বলেননি।’’

বেলোয়ারি ঝাড়

সুন্দরী আকর্ষক শেফালির জীবনে পুরুষরা এসেছেন বারবারই। তবে প্রেম বলতে তখনকার বম্বের একটি সম্পর্কের কথাই মনে রাখতেন শিল্পী। নিজের পেশাগত জীবন, পারিবারিক দায়িত্ব ছেড়ে কারও উপরে নির্ভর করার কথা তখন আর ভাবতে পারেন না দৃপ্ত বাঙালিনী। পরবর্তী জীবনের পুরুষরা বেশির ভাগই বিবাহিত। তাঁদের কারও সঙ্গেই স্থায়ী ঘর বাঁধা সম্ভব ছিল না। শেফালির আকর্ষণের আগুনে ঝাঁপিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু ক্যাবারে গার্লের সঙ্গে যৌথজীবনের সাহস দেখাতে পারেননি তাঁরা। জীবনের শেষ অঙ্কেও বাঙালি পুরুষের এই ভণ্ডামির কথা ভাবলে ‘মিস শেফালির’ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি লেগে থাকত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement