ফাইল চিত্র।
প্র: ‘আমার একটা বৌ দরকার’— অনেক দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন এ কথা। ‘নারী স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে আজ আপনি কী বলবেন?
উ: ঠাট্টা করে বলেছিলাম। আসলে সেই সময়ে সব দিক থেকে এত চাপ চলছিল। ডোনা, কঙ্কণা— দুই মেয়েই ছোট ছোট। তার উপর কাজের চাপ। কী হয়, আমাদের সমাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুরুষেরা বাইরের জগতে কাজ করছেন, আর তাঁদের স্ত্রীরা সংসার সামলাচ্ছেন। সেই দিক দিয়ে ঠাট্টার ছলেই বলা।
প্র: আর ‘নারী স্বাধীনতা’! সেটা কি একই জায়গায় আছে?
উ: ‘ফেমিনিজম’-এর সংজ্ঞা আজকাল অনেকটাই পাল্টেছে। সমস্ত প্রান্তিক মানুষের অসহায়তা বা কষ্ট— সবই চলে এসেছে এই ব্র্যাকেটে। অনেকটা ‘হিউম্যানিস্ট’ জায়গায় এসে গেছে। আগে ‘নারী স্বাধীনতা’ বলতে যে জঙ্গি ভাব ছিল, স্তিমিত হয়ে বিষয়টা ‘নারীবাদ’ বা ‘মানবতাবাদ’-এ পরিণত হয়েছে। তবে হ্যাঁ, সেই সময়ে কিন্তু ওই জঙ্গি ভাবটা দরকারও ছিল।
প্র: আর একটু বুঝিয়ে বলবেন?
উ: ধরা যাক, চাইল্ড অ্যাবিউজ বা ট্র্যাফিকিং কিংবা খনি শ্রমিকদের কষ্ট... প্রান্তিক ও মাইনরিটির সব সমস্যা ও অসহায়তার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে নারীর যন্ত্রণা বা কষ্ট। আলাদা করে কেবলমাত্র নারীর দুঃখকষ্ট বলে কিছু আর প্রকট হয়ে উঠছে না। প্রান্তিক বা সংখ্যালঘুর সমস্যার মধ্যেই পড়ছে এই বিষয়টা। বলা যায় নারীবাদের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিক্রম-সোনিকা আমার বন্ধু, তবু আজ আমি মুখ খুলছি
প্র: আপনার ছবি ‘সোনাটা’তেও দেখলাম তিন বান্ধবী গল্পের ছলেই বলছে, ‘‘আমরা এমনকী ফেমিনিস্টও নই। আমরা রোজগার করি, খরচ করি।’’
উ: ওরা ঠাট্টা করেই বলেছে।
প্র: কিন্তু বলেছে তো! অপর্ণা সেনের ছবির তিন প্রধান নারী চরিত্র গল্পের মধ্যে বলছে যে ‘আমরা ফেমিনিস্ট নই’। ভাবা যায়! মেয়ে হিসেবে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো ব্যাপার!
উত্তর: আসলে সম্পূর্ণ সাদা বা সম্পূর্ণ কালো বলে তো কিছু হয় না। সাদা-কালো মেশানো অনেক স্তর থাকে চিন্তায়। জীবনে। সেটাই উঠে এসেছে ছবিতে।
তবে ওরা তিনজনেই কিন্তু ‘ফেমিনিস্ট’। হয়তো সোচ্চার বিপ্লব করছে না। কিন্তু জীবনযাত্রায় ওরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। যে যার মতো করে জীবনকে উপভোগ করছে।
প্র: তা ঠিক। আচ্ছা, এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি ‘পরমা’ বানাতেন, তা হলে কী রকম হত? পরমা কি এখনও এ ভাবেই রিঅ্যাক্ট করত?
উ: এক কথায় কি বলা যায়? হয়তো অন্য রকম ভাবে ভাবতাম! হয়তো বানাতামই না।
প্র: আপনি এক সময়ে বলেছিলেন, গৃহবধূদের মাইনে পাওয়া উচিত। তাঁদের কাজের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। আজও কি একই কথা বলবেন?
উ: আমার মনে হয়, যাঁরা সারা জীবন প্রাণ দিয়ে সংসার করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে সমমর্যাদা পান না।
তবে মেয়েরা আজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সমাজের সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।
আর শুধু মেয়েদের কেন, পরিবারের কাঠামোরও বিরাট পরিবর্তন হয়েছে।
প্র: মানে?
উ: আজকাল কিন্তু পরিবার মানে সেই চিরাচরিত কয়েকটি সম্পর্কের সহাবস্থান নয়। স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা-ভাই-বোন, শ্বশুরবাড়ি বাপের বাড়ি— এভাবে মানুষ বসবাস করছে না। যে যার সঙ্গে সুবিধেজনক ভাবে জীবন কাটাতে পারবে, তার সঙ্গেই থাকছে।
হয়তো দু’টি মেয়ে বা দু’টি ছেলে, তারা হয়তো ‘লেসবিয়ান’ বা ‘গে’ নয়, বা হতেও পারে— একসঙ্গে থাকছে। অথবা আরও নানা স্ট্রাকচারে মানুষ বসবাস করছে।
কোনও কোনও পরিবারে আবার দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী ও দু’জনেরই মা-বাবা একসঙ্গে থাকছেন। সমাজের সামগ্রিক চেহারাটাই পাল্টাচ্ছে। আর ‘নারী’ সেখানে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আলাদা করে প্রকট নয়।
প্র: আচ্ছা, একটা কথা আজকাল খুব জানতে ইচ্ছে করে, অনেক সুখী ও আদুরে ‘হোমমেকার’ আছেন, যাঁদের দেখলে মনে হয়, সমাজের ঠিকঠাক সফল পুরুষকে বিয়ে করে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন চালিয়ে নিয়ে যাওয়াও মেয়েদের একটা কেরিয়ার হতে পারে। মানে ‘সফল পুরুষের বৌ’ হওয়াও একটা কেরিয়ার। কিছু বলবেন এ ব্যাপারে?
উ: হতে পারে একটা কেরিয়ার অপশন। কোনও কোনও মেয়ে বাড়ি পরিচালনাই বেছে নেন। হয়তো তাঁর স্বামী যথেষ্ট রোজগার করেন।
সে ক্ষেত্রে যদি দু’জনে নিজেদের মধ্যে কথা বলে স্থির করেন, কিছু বলার নেই। তবে হ্যাঁ, সে সব ক্ষেত্রে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে এবং সেই অ্যাকাউন্টের উপরে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই সমান অধিকার থাকতে হবে।
প্র: বলতে চাইছেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দিকটা ভুললে চলবে না। গয়না, শাড়ি, বাড়ি... কেবল পার্কসের উপরেই জীবন চলে না। তাই তো?
উ: এ ছাড়াও আর একটা কথা— নরওয়ে, সুইডেনের মতো বিদেশের অনেক জায়গায় মেয়েদের মাতৃত্বের ছুটির সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরাও ছুটি পান। কত সুবিধে। সেই ব্যাপারগুলোও আসতে হবে সমাজে।
প্র: বলা হয়, প্রত্যেক সফল পুরুষের সাফল্যের পিছনে একজন নারী থাকেন। তা হলে আজকাল যে সব নারী সফল হচ্ছেন, তাঁদের সাফল্যের পিছনে কারা থাকেন?
উ: এগুলো কথার কথা। আমি অনেক পুরুষকে জানি, যাদের বাড়ি তিক্ততায় অশান্তিতে ভরে আছে, তবুও তারা বাইরের জগতে সফল।
প্র: হয়তো অন্য কোনও নারী আছেন?
উ: এ ভাবে ভাবতে গেলে তো সবার জন্যেই সবাই থাকে। কোনও নারীর সাফল্যের পিছনে থাকতে পারে তার বাবা-মা বা স্বামী বা শাশুড়ি।
প্র: আমার এক বান্ধবী বলেছিল, একজন নারীর সাফল্যের পিছনে থাকে একজন সেবিকা বা বাড়ির কাজের লোক।
উ: হতে পারে। হয়তো খুব ভাল হেল্পার। বাড়িটা পুরো সামলে দিচ্ছে। শুধু হেল্পার কেন, আজকাল ওয়ার্কিং মহিলাদের সন্তানদের তো মোটামুটি তাঁদের মা বা শাশুড়িরাই সামলে দেন দেখি।
অনেক জায়গায় দেখা যায়, পালা করে নিজের মা বা শাশুড়ি-মা বাচ্চা সামলাচ্ছেন। কর্মজগতে মেয়েদের সময় কই! সেভাবে আমাদের এখানে তো ক্রেশও নেই।
এ রকম যদি হয়, কয়েক জন বান্ধবী মিলে একটা ক্রেশ করে নিজেদের বাচ্চাদেরই দেখল, কত সুবিধে হত। ধীরে ধীরে হবে হয়তো। সমাজে আরও নানা পরিবর্তন হবে। হতে বাধ্য।
প্র: একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আপনার নিজের অভিনীত পুরনো দিনের ছবি দেখতে আপনার কেমন লাগে?
উ: ওই আর কী! হয়তো চ্যানেল সার্ফ করতে করতে দেখলাম ‘মেমসাহেব’ বা ‘বসন্ত বিলাপ’ হচ্ছে।
মনে হল, ও মা! সৌমিত্রকে কী রকম দেখতে ছিল... বা আমি কী রকম সেজেছিলাম অথবা অনুপদার অভিনয়... মানে সেই সময় তো ছবিগুলো খুব উঁচু দরের হত না। মিনিট দশেক হয়তো দেখলাম।
তার পর সার্ফ করতে করতে অন্য দিকে চলে গেলাম। এই রকম আর কী।
প্র: আরেকটা জিজ্ঞাস্য— আপনার ছবিতে বারেবারেই শাবানা আজমিকে দেখতে পাই। বাঙালি দর্শক হিসেবে কিন্তু আমাদের শর্মিলা ঠাকুর বা জয়া বচ্চনকে আপনার ছবিতে দেখতে ইচ্ছে করে। রাখি বা মৌসুমীকে তবু দেখা গেছে।
উ: আরে বাবা, চরিত্র যেমন চাইবে সেই হিসেবেই তো অভিনেতা নির্বাচিত হবেন। আমি তো অভিনেতা ভেবে তার পর স্ক্রিপ্ট লিখি না।
প্র: আচ্ছা, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি সম্পর্কে কিছু বলবেন?
উ: না, না ও রকম ভাবে আমি কিছু বলব না। এরা সবাই আমার স্নেহের। সকলের ছবিই ভাল লাগে।
আর যদি কিছু বলতেও চাই, তা হলে সেটা তাদের ব্যক্তিগত ভাবে বলব। এ ভাবে সাক্ষাৎকারে বলব কেন?
প্র: বেশ, তা হলে নিজের পরিচালিত তিনটি ছবি বলুন, যা আপনার ভাল লাগার এক দুই তিন নম্বরে আসবে।
উ: ঠিক এক-দুই-তিন হিসেবে বলতে পারব না। তবে ‘পারমিতার একদিন’, ‘জাপানিজ ওয়াইফ’ ও ‘আরশিনগর’ আমার বেশ প্রিয়।
প্র: আর ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেন’?
উ: হ্যাঁ। ওটা আর আলাদা করে বললাম না।
নিবেদিতা দে