ইন্দুবালা নিয়ে বিতর্কের মাঝে একান্ত সাক্ষাৎকারে জয়তী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
সম্প্রতি শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় অভিনীত ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ সিরিজ় মুক্তি পেয়েছে। দেবালয় ভট্টাচার্য পরিচালিত এই সিরিজ় প্রশংসাও কুড়িয়েছে। হয়েছে বিতর্কও। এর আগে অভিযোগ এনেছিলেন সিরিজ়ের সঙ্গীত পরিচালক অমিত চট্টোপাধ্যায়। তিনি নাকি বার বার হুমকি পাচ্ছিলেন। বুধবার ভিন্ন অভিযোগ আনলেন সঙ্গীতশিল্পী জয়তী চক্রবর্তী। ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে আমার একটি গান আছে বলে জানতাম। অনেক আশা নিয়ে দেখতে বসে দেখলাম গানটি আমার কণ্ঠে নেই। কোনও শিল্পীর আশাভঙ্গ হওয়ার দায় কখনও কেউ নেননি আর নেবেনও না এ কথাও সত্যি। তবুও যাঁদের বলেছি যে, শুনবেন, দেখবেন আমার গান আছে। গানটি বড় ভাল। এই মিথ্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার প্রচেষ্টা করলাম মাত্র।’’ বর্তমানে গানবাজনার দুনিয়ায় নানা সমস্যা নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন জয়তী।
প্রশ্ন: গানবাজনার জগতে পারস্পরিক বিশ্বাস কি তবে হারিয়ে যাচ্ছে?
জয়তী: ‘গান’ বিষয়টাই তো বিশ্বাস। কাজের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে, সেই কাজের সঙ্গে সংযুক্ত বাকি কয়েক জন মানুষের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে আপনি কোনও ভাবেই নিশ্চিন্ত মনে কাজটা করে শান্তিতে বাড়ি ফিরে ঘুমোতে পারবেন না। সার্বিক ভাবে সঙ্গীত, সে রবীন্দ্রনাথের গান হোক বা পঞ্চকবির গান— যে শব্দগুলো আমরা উচ্চারণ করি, সেগুলো বিশ্বাস না করলে কি সেই গান অন্য কাউকে স্পর্শ করবে? নিজের অন্তরকেই যদি সেই গান স্পর্শ না করে, তা হলে অন্যের অন্তরকে তা স্পর্শ করবে কী করে? এ জন্যই বিশ্বাসটা জরুরি। আমার মনে হয়, সারল্য না থাকলে, বিশ্বাস করতে না পারলে, এক জন প্রকৃত শিল্পী হয়ে ওঠা যায় না। একটা গানকে ধারণ করতে গেলে ভেতরটা শূন্য করতে হয়। বিশ্বাস ছাড়া কিচ্ছু হয় না। শুধু গানকে বিশ্বাস করা নয়, গানের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের প্রতি আমার বিশ্বাস না থাকলে আমি একটা কাজ নিশ্চিন্ত ভাবে করতে পারব না। তাই যা-ই হয়ে থাক, আমি কখনও বিশ্বাস হারাতে চাই না।
‘রয়্যালটি পাওয়ার সম্মান থেকে আমরা বঞ্চিত’ ছবি: ফেসবুক থেকে।
প্রশ্ন: আজকালকার শিল্পীরা সে ভাবে রয়্যালটি পান না। চলবে কী ভাবে?
জয়তী: রয়্যালটি বা স্বত্বের প্রসঙ্গ তখনই আসে যখন, আমরা কোনও সংস্থার সঙ্গে কাজ করি। দু’ভাবে এই কাজ হয়। প্রথম ক্ষেত্রে, গানের জন্য এককালীন একটা টাকা দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়্যালটি। যা অতীত থেকে হয়ে এসেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। কারণ, এখন প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। অতীতে আমি এইচএমভি কিংবা আশা অডিয়োর সঙ্গে কাজ করেছি। সেখান থেকে আমি রয়্যালটি পেয়ে চলেছি। এইচএমভি-র থেকে ৩৩২ টাকা পেলেও সেটা এখনও আসে। কিন্তু পরবর্তী কালে অন্য কোনও সংস্থা বা অন্য কোনও ইউটিউব চ্যানেলের জন্য যখন কাজ করেছি, তখন এককালীন টাকা এসেছে, যা দিয়ে সত্যিই একটা গানকে পরিমাপ করা যায় না। তার কারণ, সেই গান মানুষের কাছে কতটা পৌঁছবে, যাঁরা রেকর্ড করাচ্ছেন বা যাঁরা গাইছেন—তাঁরা কেউ তা জানেন না। এ বার সেই গান জনপ্রিয় হলে তার থেকে প্রাপ্ত অর্থ পুরোটাই পেয়ে যান যিনি গানটি করাচ্ছেন তিনি। সেখানে শিল্পী তাঁর প্রকৃত প্রাপ্য পাচ্ছেন না। আবার উল্টোটাও সত্যি। কোনও ভাবেই সেই গান মানুষের কাছে পৌঁছল না, কিন্তু শিল্পী এককালীন অর্থ পেয়ে গেলেন, সে ক্ষেত্রে যিনি গানটি করালেন তিনি তাঁর প্রাপ্য পেলেন না। এই দু’টিই ঘটে থাকে এবং আমি দুটোরই সাক্ষী থেকেছি। সুতরাং এই সব বিষয়ের উপর নির্ভর করে শিল্পীদের জীবন চালানো কঠিন।
প্রশ্ন: তা হলে উপায়?
জয়তী: এখনও পর্যন্ত আমাদের বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে অনুষ্ঠানই একমাত্র মাধ্যম, যেখান থেকে শিল্পীরা উপার্জন করতে পারেন। জীবন চালানোর জন্য। আমরা সবাই সেই লড়াইয়ে শামিল। রয়্যালটিটা আমার মনে হয় অনেক সম্মানজনক। সেই সম্মান থেকে আমরা বঞ্চিত। ক্রমে আরও বঞ্চিত হতে চলেছি। কোনও সংস্থা আর সেই ঝুঁকি নিতে চাইছে না। অন্য দিকে, অনেক শিল্পীও চান যে, ধীরে ধীরে অর্থ পাওয়ার থেকে দ্রুত এককালীন অর্থ পেতে। কারণ গানবাজনার প্রতি সেই বিশ্বাস বা আস্থা কাজ করছে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তব।
‘মানুষ এখন উপার্জনের জন্য ‘রিলস’ তৈরি করছে।’ ছবি: ফেসবুক থেকে।
প্রশ্ন: তা হলে ভবিষ্যতে পেশাদার শিল্পী পাওয়া কঠিন হবে? কেউ চাকরি বা অন্য কোনও কাজ করবেন আর পাশে গানবাজনাটা থাকবে?
জয়তী: আমার মনে হয়, এটা সব সময়ই তুলনামূলক ভাল বিকল্প। চাকরির ফলে প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অর্থ পাওয়া যায়, যা দিয়ে সংসার চলে। এর পর শখে গানবাজনা করলে তা একজন মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য সম্মানজনক। এর ফলে এই সঙ্গীত জগতের সঙ্গে কমপ্রোমাইজও কম করতে হয়। ফলে আপনার হাতে ‘চয়েস’ থাকে। কিন্তু আমাদের মতো যাঁরা গানবাজনাটাই করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই বিকল্প বেছে নেওয়াটা ঝুঁকির হয়। মনে হয় যে, আমার স্বপ্ন দেখার জায়গাটাই চলে গেল। আগে তো স্বপ্ন দেখতে হয়। স্বপ্ন থাকে, আমার সবচেয়ে বড় যে প্যাশন, সেটা নিয়েই আমি আমার জীবনের পথ চলছি, উপার্জন করছি। এই স্বপ্ন দেখার জায়গাটাই এখন ঘেঁটে গিয়েছে। আমরা তা-ও কিছুটা পেরেছি এবং কোনও ভাবে চালিয়ে যেতে পারছি। কিন্তু এটা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সত্যিই হয়তো নড়বড়ে জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন: কিন্তু উল্টো দিকটাও কি সত্যি?
জয়তী: ঠিক। এর উল্টো দিকটাও সত্যি। কারণ, এই প্রজন্মের অনেক তাড়া রয়েছে। তারা চটজলদি কিছু একটা পেতে চায়। ধৈর্য ধরে কিছু করতে চায় না। তারা স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য রেখে এগোচ্ছে। হয়তো জগৎটাও এ ভাবে বদলেছে বলেই করছে। এখন দুনিয়াটা যেমন, তাতে আমার মনে হয়, এ ভাবেই ভাবা উচিত যে, আমার একটা পেশা থাকল, তার পাশে আমি গানবাজনা করছি। সেখান থেকে আমার পাওয়ার কিছু নেই। দেওয়ার আছে।
প্রশ্ন: ডিজিটাল দুনিয়াই এখন সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই দুনিয়াও তো খুব গোলমেলে… এখান থেকে কি ঠিক মতো প্রাপ্য মিলছে?
জয়তী: সত্যি বলতে, আমি ইউটিউব, ফেসবুকের অ্যালগরিদম বুঝি না। এটা ঠিকই যে, এখন গানবাজনার বিচার হচ্ছে ‘ভিউ’ দিয়ে। কার গান কত ‘ভিউ’ হচ্ছে, তাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে নির্ণায়ক। কিন্তু যে রকম ‘ভিউ’ হচ্ছে, সেই অনুপাতে প্রাপ্য আসছে না। অর্থ আসে ঠিকই, কিন্তু যতটা পাওয়ার কথা, ততটা পাওয়া যায় না। কপিরাইটও বড় একটা সমস্যা। নতুন গান, নতুন ট্র্যাক করে নতুন কোনও মোড়কে পুরনো গান উপস্থাপন করতে হচ্ছে। কিন্তু, রিমেক গান করলে ততটা অর্থ পাওয়া যায় না। কারণ, সেখানে যাঁর গান, যে কোম্পানি থেকে সেটা প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে অর্থ যাওয়ার পর যিনি রিমেক করলেন, তাঁর কাছে টাকা আসে। তা হলে উপার্জন করতে গেলে নতুন গান করতে হবে। নতুন গানের ‘অর্গানিক ভিউ’ হলে তবে কিছু অর্থ পাওয়া যায়। কিন্তু নতুন গান তো অতটা জনপ্রিয় হয় না, যতটা পুরনো গান মানুষের কাছে পৌঁছয়। মানুষ এখন উপার্জনের জন্য ‘রিলস’ তৈরি করছে। ‘শর্ট ভিডিয়ো’ বানাচ্ছে, কিংবা বাড়িতে বসেই একটা হারমোনিয়াম বা কি বোর্ড বাজিয়ে রেকর্ড করে ইউটিউবে তুলে দিচ্ছে। সেখান থেকেও কিছু আয় হয়। তবে এটা খুব বুদ্ধি করে করতে হয়। আর এটা করার জন্য শিল্পীর মাথা যথেষ্ট নয়। এর জন্য দরকার কিছু পেশাদার মানুষ।