সকলেই কবি নয়…
কিন্তু ফেসবুকের রাজ্যে সকলেই কবি!
হাজারো আইডিয়া, শব্দের গুচ্ছ, প্রেম, প্রতিবাদ, মন খারাপ কয়েকটা লাইন হয়ে নেমে আসছে। অমনি কবিতা হয়ে ওয়ালে পোস্ট, আর শ’য়ে-হাজারে ভিউয়ারশিপ। প্রচুর লাইক। কবি হিসেবে নামী নন তেমন, হয়তো বই ছাপা হয়নি এখনও কোনও, এমন ফেসবুক-কবিদের সংখ্যাটা কিন্তু নেহাত কম নয়! এমন অনেকের লেখা নিয়েও বেশ নাড়াচাড়া হয় ফেসবুকে। অজানা অচেনা পাঠককুল কখনও এদের কোনও কবিতা পছন্দ করলে সেগুলো নিজের ওয়ালে শেয়ারও করেন। এই চল দিব্যি আছে ফেসবুকে। অনিমেষ বৈদ্য যেমন রোহিত ভেমুলা হ্যাশট্যাগ দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মৃত্যু ছাড়া খবর হয় না, হলেও মূল্যহীন,/ আমরাও থাকি চুপচাপ আর মুখ গুঁজে উদাসীন।/ বিতাড়িত হয়ে হোস্টেল ছেড়ে বাইরে কাটানো রাত,/ খবর পাইনি, গর্জে ওঠেনি মুষ্টিবদ্ধ হাত।/মৃত্যু দিয়েই খুলে দিয়ে গেলি বন্ধ হাজারো চোখ,/ মরেছিস বলে কথা হয় আজ, চর্চা করছে লোক!/ আত্মহত্যা? নাকি আসলে খুন করা হল তাকে?/ উত্তর জানি লেখা আছে এই সমাজের ফাঁকে ফাঁকে…’ অথবা ‘বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্র করেছে ধার্য,/ সেরা গুরুর পদকটিতে নাম লেখা দ্রোণাচার্য।/ গুরু তুমি সেরা বটে, মহান তুমি ছিলে,/ একলব্যের নষ্ট জন্ম, আঙুল কেটে নিলে।/ অর্জুনের উচ্চ জাত, মহান হওয়াই রীতি,/ একলব্যের জন্য রাখা অবিচারের নীতি।/ সেরা গুরু দ্রোণাচার্য আজও আমরা মানি,/ পায়ের নীচে রেখে দিয়ে কাটা আঙুলখানি।’
‘‘বিশুদ্ধবাদীরা নাক কুঁচকোতেই পারেন। কিন্তু সময়ের বহমানতা অনেক সো-কল্ড নন-সিরিয়াস প্ল্যাটফর্মকেও সিরিয়াস করে তোলে। এবং একটা বড় সুবিধে, ইমিডিয়েট ফিডব্যাক’’, বলছিলেন ঈশান বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও নিয়মিত কবিতা পোস্ট করেন ফেসবুকে। এখন আবার আলাদা করে ‘নোট’ বলে একটি বস্তু বানানোর সুবিধেও রয়েছে। সেই সব কবিতা-পোস্টের লাইকের প্যাটার্ন দেখে বোঝা যায়, কিছু নিয়মিত পাঠক তো আছেনই এঁদের, ফেসবুক-কবিদের।
এঁদের অনেকেরই বক্তব্য, ২০১৬-র পাঠক এতটাই ব্যস্ত, সে বড়জোর মাসে এক বার কবিতাসভায় সশরীরে যোগ দিতে পারবে। কিন্তু যাঁর বা যাঁদের কবিতার প্রতি আগ্রহ, তাঁরা ফেসবুকে কবিতা নিয়ে ওই আড্ডাটা রোজ সব সময়েই দিতে পারবেন। ফ্রেন্ডশিপ ডে-তে লেখা ঈশানের একটা ফেসবুক-কবিতা, ‘খুনসুটি-রং। ইচ্ছেদুপুর। আমকাঁচা কষ।/স্ট্রিট চাউমিন। সম্পর্কের গায়ে লাগা সস।/ ক্লাসরুমে কেউ নেই কোত্থাও। ফিরবে না আর।/ কাঠের বেঞ্চে শুধু লেখা আছে বন্ধুদিবস।’ বা ‘একলা যুবতীদেহ। আটকে রাখা খিল।/ অবশ নক্ষত্র তার। বিরহমিছিল।/ নাভিতে কেমন করে জন্মালো গাছ?/ এ প্রশ্ন তোলো যদি, তুমি অশ্লীল!’
আর এক কবি নির্মাল্য সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘জাত নেই, ধর্ম নেই, ঈশ্বরে নিরাসক্ত/ আমরা সবাই মানুষ, আমরা মিয়া খালিফার ভক্ত।’
তাঁর ফেসবুক ওয়ালেও নিয়মিত কবিতা পোস্ট করেন তিনি, শ্রীজাত। সম্প্রতি যেমন দু’লাইন লিখেছেন, ‘রাষ্ট্র নয়। ধৃতরাষ্ট্র। কে বইবে অন্ধতার পাপ?/ শাস্ত্রে তো লেখাই আছে, আত্মহত্যা করা মহাপাপ!’ বা তার ক’দিন আগে, ‘শব্দের আড়াল শুধু। কথা শুয়ে মলাটের ফাঁকে।/ পাঠক জানে না আজও, গল্পের ভেতরে কারা থাকে…’
কিন্তু পোস্টটি যাঁরা লাইক করছেন, সেই হাজার-দু’হাজার মানুষ কি সকলেই পড়ে করছেন লাইক? শ্রীজাত-র কথায়, ‘‘অনেক দিন ধরে দেখতে দেখতে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়, কারা পড়ে লাইক করছেন। কিছু মানুষ তো থাকেনই যাঁরা আলু-পোস্ততেও লাইক করেন, কবিতায়ও। কিন্তু দেড়শো-দু’শো জন এমন থাকেনই যাঁরা কবিতাটা পড়েই লাইক করেন, বা কমেন্ট করেন।’’
তবে কি ফেসবুক-কাব্য বইয়ের পরিপূরক?
শ্রীজাত বলছেন, ‘‘পরিপূরক নয় অবশ্যই। ব্লগার অভিজিৎ-এর মৃত্যুর পরে ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ শুরু করি ফেসবুকেই। তার পরে একটা সময়ে অনেকেই জানতে চান, ‘বই হিসেবে কবে পাচ্ছি এটা?’ তার পরে বই হয়ে বেরোলো ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’।’’
তবে ফেসবুক এখন অনেক নতুন ফর্ম, অনেক নতুন ভাবনার ভার্চুয়াল পৃষ্ঠপোষক। কখনও কখনও কবিদের নাম গৌণ হয়ে যায়। শব্দ বা ছন্দগুলো জেগে থাকে পাঠকের মনে বহুকাল।