‘শাম্মি কপূরের ছেলে হয়ে নিজের হাতে ট্রাকে মালপত্র ভরছেন!’ এই কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু খারাপ লাগা বা হীনমন্যতাকে মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে দেননি।
নিজে ছক ভেঙে ছিলেন। তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। কপূর পরিবারের অন্যতম এই সদস্য এক জন সফল শিল্পপতি।
১৯৫৬ সালের ১ জুলাই জন্ম শাম্মি কপূর ও গীতা বালির একমাত্র ছেলের। নাম রাখা হয়েছিল আদিত্য রাজ কপূর।
বলিউডের অন্যতম স্তম্ভ কপূর পরিবারের সদস্য হয়ে লাইট সাউন্ড ক্যামেরার দুনিয়ায় আসবেন না, তা-ই বা কী করে হয়!
তবে অভিনয় নয়, আদিত্য কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ক্যামেরার পিছনে।
১৯৭৩ সালে তিনি তাঁর জেঠু রাজ কপূরের ছবি ‘ববি’-তে সহকারী পরিচালক ছিলেন।
এর পর ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’, ‘গেরেফতার’, ‘সাজন’, ‘আরজু’-সহ বেশ কিছু ছবিতে তিনি ছিলেন সহকারী পরিচালক।
‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবিতে শশী কপূরের বডি ডাবল হিসেবেও কাজ করেছিলেন আদিত্য। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষে তিনি সরে যান সিনেমার রঙিন দুনিয়া থেকে।
আবার ফিরে এসেছিলেন এক দশক পেরিয়ে। কিন্তু তার মাঝে নিজের জীবনকে বর্ণময় করে তুলেছেন নিত্যনতুন চিত্রনাট্যে।
আদিত্য যখন মাত্র ন’বছরের, মারা যান তাঁর মা, অভিনেত্রী গীতা বালি। চার বছর পরে দ্বিতীয় বিয়ে করেন শাম্মি কপূর।
তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী নীলা দেবীরও খুব আদরের শাম্মি-গীতার দুই ছেলে মেয়ে আদিত্য ও কাঞ্চন। শোনা যায়, তাঁদের জন্য স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলেন মা হওয়ার স্বপ্ন।
ছেলেকে অভিনেতা হওয়ার জন্য চাপ দেননি শাম্মি কপূরও। নিজেই পরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন আদিত্য। বরং, তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই পড়তে বলতেন শাম্মি।
বই ছাড়া আরও এক জায়গায় শান্তি খুঁজে পেতেন আদিত্য। হিমালয়ের কোলে নিজের গুরুজির আশ্রমে।
গুরুজির কথায় তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত আদিত্য নতুন করে জীবন শুরু করেন। ব্যবসার জন্য পুঁজি যোগাড় করতে প্রথমে কাজ নিলেন অন্যের কাছে।
পারিবারিক গরিমা এক পাশে সরিয়ে কঠোর পরিশ্রম করলেন। এক সময় কিছু সঞ্চয় হল।
সেই সঞ্চয়ের উপর ভিত্তি করে আদিত্য শুরু করলেন নিজের ব্যবসা। প্রথমে তাঁর কোনও কর্মী ছিল না। ভাড়া করলেন গুদামঘর এবং ট্রাক।
নিজেই গুদামঘর থেকে মালপত্র নিয়ে ট্রাকবন্দি করতেন। সে সময় পরিচিতদের কাছ থেকে উড়ে আসা তির্যক মন্তব্য দূরে সরিয়েই কাজ করতেন তিনি।
সম্পূর্ণ শূন্য থেকে শুরু করে ব্যবসাকে কাঙ্খিত উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন আদিত্য। এখন তিনি নামী নির্মাণ সংস্থার কর্ণধার। তাঁর সংস্থার হাতেই তৈরি হয়েছে দিল্লিতে ‘ফ্যান্টাসি ল্যান্ড’ এবং মুম্বইয়ে ‘আপ্পুঘর’।
সফল শিল্পপতি আদিত্য আবার ফিরে এসেছিলেন বিনোদন দুনিয়ায়। ২০০৭ সালে তিনি পরিচালনা করেছিলেন ‘ডোন্ট স্টপ ড্রিমিং’ এবং ‘সম্বর সালসা’ ছবি দু’টি।
বলিউডে দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁকে দেখা গেল ক্যামেরার সামনেও। ‘চেজ’, ‘দিওয়ানগি নে হদ কর দি’, ‘ইসি লাইফ মেঁ’, ‘সে ইয়েস টু লভ’, ‘ইয়ামলা পাগলা দিওয়ানা’-র মতো ছবিতে তিনি অভিনয়ও করেছেন।
অভিনয়, নিজের ব্যবসার পাশাপাশি আদিত্যর আরও বিভিন্ন শখ আছে। চেষ্টা করেন তাদের পিছনেও সময় দিতে। তিনি বাইক চালাতে ভালবাসেন। নিজের বাহন নিয়ে চষে ফেলেছেন সারা ভারত।
বছর ছয়েক আগে বাইক নিয়ে ভারত-সফরে বের হয়েছিলেন আদিত্য। মুম্বই থেকে যাত্রা শুরু করে দেশের বিভিন্ন শহরে তো পাড়ি দিয়েইছিলেন, বাইক চালিয়ে ঘুরে এসেছেন নেপাল, ভুটানের মতো পড়শি দেশেও।
সময় পেলেই আদিত্য রং-তুলি নিয়ে বসে পড়েন। কখনও আবার রান্নাঘরেই কেটে যায় দিনের বেশির ভাগ সময়। নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে। নাচ এবং লেখালেখিতেও আগ্রহ আছে আদিত্যর।
দীর্ঘ কয়েক দশক কাটিয়েছেন কর্পোরেট পরিবেশে। এ বার তিনি খোলা হাওয়ায় উপভোগ করতে চান জীবন।
পৃথ্বীরাজ কপূরের নাতি হয়ে অভিনেতা হতে পারেননি, এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই। বরং, পারিবারিক ধারার বিপরীতে গিয়ে সফল কর্পোরেট হতে পেরে খুশি আদিত্য।
তাঁর কথায়, পৃথ্বীরাজ কপূরের বাবা অর্থাৎ তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারের উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক তথা নামী জমিদার। তিনি কি কোনওদিন ভেবেছিলেন তাঁর ছেলে এবং পরিবারের আগামী প্রজন্মকে দেখা যাবে ছবির জগতে?
ঠিক সে রকমই তিনিও নতুন ধারায় পা রেখেছেন। জোর করে কিছু করার থেকে নিজের মনের কথা শোনা-ই ভাল। মনে করেন শাম্মি-পুত্র সফল শিল্পপতি আদিত্য রাজ কপূর।
তা ছাড়া অভিনেতা বা তারকা হিসেবে বাবার সঙ্গে তুলনার হাত থেকেও তিনি বেঁচে গিয়েছেন বলে মনে করেন আদিত্য। শাম্মি কপূরের সঙ্গে কেমন ছিল তাঁর সম্পর্কের সমীকরণ?
ছবি নিয়ে কোনও কথা হত না। কারণ তাঁদের দু’জনের জগৎ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। জানিয়েছেন আদিত্য। তবে বাবার স্নেহ থেকে তিনি কোনও দিন বঞ্চিত হননি।
দূরত্বের জন্যই ইন্ডাস্ট্রিতে সে ভাবে পরিচিত নন আদিত্য। আশুতোষ গোয়ারিকর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গোয়ারিকরের পরিচালনায় টেলিভিশন সিরিজ ‘এভারেস্ট’-এও অভিনয় করেছেন তিনি।
নিজের মতো পরিবারকেও আড়ালে রাখতে ভালবাসেন আদিত্য রাজ কপূর। জমকালো অনুষ্ঠানের পথে না গিয়ে গুরুজির আশ্রমে তিনি বিয়ে করেছিলেন ১৯৮২ সালে। ঘরোয়া সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিল গোটা কপূর পরিবার।
স্ত্রী প্রীতি এবং দুই সন্তান নিয়ে আদিত্যর সংসারেও প্রচারের আলোর বিশেষ প্রবেশ নেই। স্বজনপোষণ নিয়ে শোরগোলের যুগে শাম্মি কপূরের ছেলে আদিত্য রাজ কপূর যেন এক ঝলক টাটকা বাতাস।