(১৯৩৪-২০১৯)
মারা গেলেন রুমা গুহঠাকুরতা। বালিগঞ্জের বাড়িতে বার্ধক্যজনিত কারণে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
অভিনয় ও সঙ্গীতে অসম্ভব প্রতিভাময়ী রুমার জন্ম ১৯৩৪ সালে। সাত বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে আলমোড়ায় গিয়েছিলেন তিনি। উদয়শঙ্করের কালচারাল সেন্টারে ভর্তি হন। পরে উদয়শঙ্করের সঙ্গেই বেরিয়ে পড়েন ভারত পরিক্রমায়। মুম্বইয়ে শো চলাকালীন নজরে পড়েন দেবিকা রানির। তার পরেই বম্বে টকিজ়ে দশ বছরের রুমা পাঁচশো টাকা বেতনে নিযুক্ত হন অভিনেত্রী হিসেবে। ১৯৪৪ সালে অমিয় চক্রবর্তীর ‘জোয়ার ভাটা’য় প্রথম অভিনয়। পুরোদস্তুর নায়িকা হতে আরও তিন বছর। নীতিন বসুর ‘রজনী’তে অশোককুমারের বিপরীতে। এর পরে ‘মশাল’, ‘অফসর’। তবে সাংসারিক কারণেই বেশি ছবি করেননি। বম্বে টকিজ়েই আলাপ কিশোরকুমারের সঙ্গে। ১৯৫২য় বিয়ে ও পরের বছর ছেলে অমিতের জন্ম। কিশোরের সঙ্গে দাম্পত্য প্রসঙ্গে বেশির ভাগ সময়েই নিরুত্তর থেকেছেন রুমা। ১৯৯৮ সালে আনন্দলোকের এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘‘ওই সময়টা ছিল সব থেকে সুখের। একজন আরেকজনের উপর খুব নির্ভর করতাম। ...খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে আমি আর কিশোর একটা গাড়ি দেখতে গেলাম। মনে আছে লোকাল ট্রেনে চড়ে গেছিলাম।’’ ছ’বছরেই বিচ্ছেদ। ওই সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, ‘‘কিছুটা সময়ের অভাবের কারণেই আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।’’
মুম্বই ছেড়ে কলকাতায় এসে শুরু করেন বাংলা ছবিতে অভিনয়। ‘অভিযান’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘পলাতক’, ‘বালিকা বধূ’, ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘ত্রয়ী’, ‘গণশত্রু’... শেষ অভিনয় ‘দ্য নেমসেক’-এ। গানও গেয়েছিলেন নানা ছবিতে। মুম্বই ছাড়ার আগে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিক্ষার তালিম নেন আব্দুল রহমান খানের কাছে। তৈরি করেন ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’। সঙ্গে পেলেন সলিল চৌধুরী ও মামা সত্যজিৎ রায়কে। সেই শুরু। যে ভাবে গানের মাধ্যমে সুসংহতি এবং শান্তির বার্তা রুমা শিখিয়েছেন, তা অকল্পনীয়। কলকাতায় ফিরে নতুন করে সংসার পাতেন অরূপ গুহঠাকুরতার সঙ্গে। সত্যজিতের ইউনিটের সদস্য অরূপ যেমন ভাল গাইতেন, তেমন দারুণ নাটকও করতেন। রুমা-অরূপের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ জনপ্রিয় হয়। অরূপের সঙ্গে রুমার বিয়ের পরে জন্ম হয় অয়ন ও শ্রমণার। সলিল চৌধুরীর মেয়ে গায়িকা অন্তরা চৌধুরীর কথায়, ‘‘ছোট থেকেই অনুষ্ঠানের জন্য ওঁর বাড়ি যেতাম। পিসি অসম্ভব মিষ্টি মানুষ ছিলেন। ডায়নামিক পার্সোনালিটি।’’
ব্যক্তিগত জীবন আড়ালে রাখতেই পছন্দ করতেন রুমা। কিন্তু বিচ্ছেদের পরেও সুসম্পর্ক ছিল কিশোর ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে। তেমনই আবার অমিতের সঙ্গে গুহঠাকুরতা পরিবারের সম্পর্কও মধুর। অমিতের বড় হওয়ার অনেকটা সময় কেটেছে সেখানেই।
সপরিবার রুমা
অমিত সোমবার মুম্বই থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছন। শেষ কিছু বছর অমিতের সঙ্গে মুম্বইয়ে থাকতেন রুমা। এই দিন সংবাদমাধ্যমকে মায়ের স্মৃতিতে তিনি বলেন, ‘‘মায়ের কাছ থেকেই সব শিখেছি আমি। ক্রিকেটের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট জেগেছে মায়ের কাছ থেকে। চার্লি চ্যাপলিন, লরেল-হার্ডির ছবি দেখেছি মায়ের কাছে বসে। জ্যাজ় গানের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন মা। এক দিকে বন্ধু ছিলেন, আবার কড়া শাসনেও রাখতেন।’’
কলকাতাতেই প্রথম স্টেজ শো করেছিলেন অমিত। ভয় ছিল, মা সেটা ভাল ভাবে নেবেন কি না। তাই মাকে না জানিয়েই শো করে আসেন। ‘‘ফিরে যখন জানিয়েছিলাম, মা খুশিই হয়েছিলেন। বাবা গান গাওয়া নিয়ে আমাকে ডিসকারেজ করতেন... কারণ ওটাই বাবার স্টাইল ছিল। বলতেন, বেশি প্রশংসা শুনলে আর উঠতে পারব না। মা কিন্তু সব সময়ে এনকারেজ করতেন।’’ ১৯৭৭-এ ‘রুমা গুহঠাকুরতা প্রেজ়েন্টস অমিত কুমার’ নামে কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে ছেলেকে দর্শকের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন তিনি। তার আগে ১৯৭৪-এ মুম্বইয়ে ছেলেকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেন কিশোর। অমিতের কথায়, ‘‘মা বলেছিলেন, ও যদি ওখানে করে, আমি এখানে তোমাকে নিয়ে করব। দু’জনের মধ্যে এ রকম চলত আমাকে নিয়ে...’’
রুমাও আপন করে নিয়েছিলেন গুহঠাকুরতা পরিবারকে। দেওরের দেখভাল, যে কোনও অনুষ্ঠানে ঝাঁপিয়ে পড়া... ভাল রান্নাও করতেন। মরিচের ঝোল, কষা মাংস, কাঁচকলার ঝুরি, শুক্তো রেঁধে খাওয়াতে ভালবাসতেন। প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন কয়্যারকে। রুমা বলেছিলেন, ‘‘আমি নিজে ধর্মে বিশ্বাস করি। কিন্তু সেই ধর্ম বিশ্বাস কোনও দেবতাকে ঘিরে নয়।’’ সঙ্গীতকে ঈশ্বর মনে করা রুমার প্রয়াণে একটি যুগের অবসান ঘটল ঠিকই, কিন্তু রয়ে গেল তাঁর কণ্ঠ, ভাবনা আর সৃষ্টি।