বাকিদের সঙ্গে তিনিও দেখতে গিয়েছিলেন শ্যুটিং। দেখেন, সেখানে সাইকেল চালানো শিখছেন জুহি চাওলা। প্রিয় নায়িকাকে চোখের সামনে দেখে তিনি তো অভিভূত। সঞ্জয় সুরী তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কিছু বছর পরে জুহির পাশে তাঁকে দেখা যাবে ছবির পর্দায়!
সুদর্শন সঞ্জয় কাশ্মীরের ভূমিপুত্র। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল তাঁর জন্ম শ্রীনগরে। দাদা রাজ এবং দিদি বন্দনার সঙ্গে উপত্যকাতেই কেটেছিল ১৯ বছর। নিসর্গের কোলে প্রকৃতিপাঠের হাতেখড়ি। পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে চুটিয়ে চলত স্কোয়াশ খেলা। প্রতিনিধিত্ব করেছেন রাজ্যস্তরের দলেও।
কিন্তু ভূস্বর্গে বেশি দিন থাকা হল না সুরী পরিবারের। আচমকাই পাল্টে গেল চিরচেনা শহর শ্রীনগর। ১৯৯০ সালে অশান্ত উপত্যকায় জঙ্গিহানায় প্রাণ হারালেন সঞ্জয়ের বাবা বীরেন্দ্র। অগ্নিগর্ভ শ্রীনগর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় সুরী পরিবার।
পরে এক সাক্ষাৎকারে সঞ্জয় জানিয়েছিলেন, তাঁদের বাড়িতে এসে জঙ্গিরা হত্যা করেছিল তাঁর বাবাকে। এর পর মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে হাতের কাছে যা ছিল, কোনওমতে সে সব নিয়েই পালাতে হয়েছিলে তাঁদের।
সঙ্গে আনতে হয়েছিল বাবার নিথর দেহও। কারণ শ্রীনগরে তাঁর সৎকার করা সম্ভব হয়নি। দিল্লিতে এসে তাঁর অন্ত্যেষ্টি করা হয়। এর পর চলে যাওয়া জম্মুতে। সেখানেই কিছু দিন ছিলেন শরণার্থী শিবিরে।
পরবর্তী গন্তব্য দিল্লি। থিতু হন সেখানেই। সব দিক থেকেই রাতারাতি বদলে গিয়েছিল জীবন। পাহাড়ে ট্রেক করতে অভ্যস্ত সঞ্জয় এ বার পরিচিত হলেন তীব্র গরম আর লু-এর সঙ্গে।
দিল্লিতে মডেলিং জীবন শুরু সঞ্জয়ের। বাণিজ্যে স্নাতক হওয়ার পরে মডেলিংকেই কেরিয়ার করলেন তিনি। বিজ্ঞাপনের দুনিয়ার প্রথম সারিতে পৌঁছতে সময় লাগেনি সুদর্শন সঞ্জয়ের। মডেলিংয়ের মাঝেই এল ছবিতে কাজের সুযোগ।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পেল সঞ্জয়ের প্রথম ছবি ‘প্যায়ার মেঁ কভি কভি’। রিঙ্কি খন্না, ডিনো মোরিয়ার সঙ্গে এই ছবিতে তিনি ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে। ছবিটি ফ্লপ করলেও নজর কেড়েছিলেন সঞ্জয়। জনপ্রিয় হয়েছিল ছবির গানও।
এর পর ‘দমন’, ‘ফিলহাল’, ‘দিল ভিল প্যায়ার ভ্যায়ার’, ‘পিঞ্জর’ ছবিতে অভিনয় করেন সঞ্জয়। তবে পরিচিতি পেতে সঞ্জয়কে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ‘ঝঙ্কার বিটস’ অবধি।
‘ঝঙ্কার বিটস’-এ নায়িকা ছিলেন জুহি চাওলা। কাশ্মীরে শ্যুটিং স্পটে তাঁকেই সাইকেল চালাতে দেখে একদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন সঞ্জয়। পরেও জুহির সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। সহঅভিনেত্রী হিসেবে জুহি অতুলনীয়, জানিয়েছেন সঞ্জয়।
কৈশোরে ‘দিল হ্যায় কি মানতা নঁহি’ দেখে তাঁর ভাল লেগেছিল পূজা ভট্টকেও। তবে মডেলিংয়ে তাঁর আদর্শ হলেন ক্রিকেটার ভিভিয়ান রিচার্ডস। তবে ক্রিকেটার নয়, ছোটবেলায় মডেল রিচার্ডসকে দেখেই বড় হয়ে মডেল হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি।
বিজ্ঞাপনের দুনিয়ার খ্যাতি পেলেও ছবিতে সঞ্জয়ের প্রত্যাশিত সাফল্য দূরেই রয়ে যায়। তাঁর ছবির গল্প ভাল হত। প্রশংসিত হত সঞ্জয়ের অভিনয়ও। কিন্তু শেষ অবধি বক্স অফিসে সফল হত না।
সঞ্জয়ের ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য হল ‘ধূপ’, ‘প্ল্যান’, ‘শাদি কা লাড্ডু’, ‘ফিরাক’, ‘সিকন্দর’, ‘হিন্দি মিডিয়াম’, ‘বস এক পল’ এবং ‘রাজি’। সম্প্রতি তিনি কাজ করেছেন বেশ কিছু ওয়েব সিরিজেও।
সমকামিতার উপর নির্মিত ছবি ‘মাই ব্রাদার…নিখিল’-এ সঞ্জয়ের অভিনয় জয় করেছিল সমালোচক এবং দর্শকদের মন। ছবির পরিচালক ছিলেন ওনির। তাঁর সঙ্গে মিলে সঞ্জয় প্রযোজনা করেছিলেন ‘আই অ্যাম’।
৪টি আলাদা গল্পকে এক সুতোয় বাঁধা এই ছবির হাত ধরেই ভারতীয় বিনোদন দুনিয়ায় পরিচিত হয়েছিল ‘ক্রাউডস্কোরিং’ পদ্ধতি। ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি পরবর্তীতে জাতীয় পুরস্কারজয়ী হয়েছিল।
সুপারহিট নায়ক কোনও দিন হতে পারেননি সঞ্জয়। সে নিয়ে তাঁর কোনও আক্ষেপও নেই। তিনি খুশি তাঁর অন্যরকম, কিন্তু সহজ বৃত্তেই। সময়ের অনেকটা জুড়ে থাকে স্ত্রী অম্বিকা ও দুই সন্তানকে নিয়ে পরিবার এবং ছবি তোলার শখ।
তবে এখনও ভুলতে পারেন না কাশ্মীরকে। বাস্তুচ্যুত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সমস্য়া এবং নিজের অতীতের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে একাধিক বার তিনি সরব হয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।