স্ত্রী মধুবনীর সঙ্গে রাজা গোস্বামী।
‘ভালবাসা ডট কম’-এর ওম এখন ‘খড়কুটো’-র রূপাঞ্জন। আর পর্দার ‘তোড়া’ ওরফে মধুবনীই এখন তাঁর বাস্তবের স্ত্রী। মাঝের বারো বছরে কতটা পাল্টাল জীবন? আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে অকপট রাজা গোস্বামী।
প্রশ্ন: ধারাবাহিকে আপনি জনপ্রিয় মুখ। ওটিটিতে দেখা যায় না কেন?
ওটিটি-তে একেবারে কাজ করিনি তা নয়। এক-আধটা চরিত্র করেছি সিরিজে। তবে বাংলা ওটিটি-তে এখনও বেশির ভাগ সিরিজে যে ধরনের দৃশ্য থাকে, তাতে আমি নিজে স্বচ্ছন্দ নই। তাই করিও না। মনের মতো চরিত্র পেলে নিশ্চয়ই কাজ করব।
প্রশ্ন: বড় পর্দাতেও তো আপনাকে দেখা যায় না?
ডাকলে তো করব! (হাসি) আসলে ঠিকমতো সুযোগ আসেনি। তাই করা হয়নি। আর ধারাবাহিকের কাজে অনেকটা সময় দিতে হয়। মাসে ২০-২২ দিন শ্যুটিং থাকে। সারা দিনের কাজ।
প্রশ্ন: আর ধারাবাহিক?
‘খড়কুটো’-য় আমি রূপাঞ্জন। এই প্রথম কমেডি চরিত্রে কাজ। সেটাই মনপ্রাণ দিয়ে করছি। হাসিখুশি মেজাজের রূপাঞ্জনকে লোকে খুব পছন্দও করছে। তাই আপাতত একটা ধারাবাহিকে কাজ করেই দিব্যি খুশি।
সপরিবার রাজা গোস্বামী।
প্রশ্ন: সে কী! অন্য অভিনেতারা অনেকেই তো একাধিক চরিত্রে একসঙ্গে কাজ করছেন। আপনি একটাতেই খুশি?
দেখুন, আমি নিজের মতো করে চলতে ভালবাসি। ‘রূপাঞ্জন’ গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ফলে আমার অনেকটা করে কাজ থাকে। দিনের অনেকটা সময় কাটে শ্যুটিং ফ্লোরে। বাকি সময়টা এখন আমার পরিবারের নতুন সদস্যকে দিতেই বেশি ভাল লাগছে। আমার ছেলে কেশব এখন মাত্র ন’মাসের। বাড়ি ফিরেই আমি সোজা ওর কাছে!
প্রশ্ন: কোভিডের মধ্যেই আপনার ছেলের জন্ম। ভয় করেনি?
করেনি আবার! অনেক অনেক বেশি সাবধানে থাকতে হয়েছে। আমার স্ত্রী মধুবনীকে তো বটেই, আমাকেও। আমি যেহেতু শ্যুটিং করতে বাইরে যেতাম, তাই বাড়তি সতর্ক থাকতাম। তবে তখন টিম ‘খড়কুটো’র কাছে যে সহযোগিতা পেয়েছি ভোলার নয়! মধুবনীর কথা ভেবে আমার সহ-অভিনেতারা, ফ্লোরের অন্যরাও অনেক বেশি সাবধান থাকত। যে পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম, ওঁরা সব সতর্ক না হলে কী যে হত!
প্রশ্ন: কী রকম?
মধুবনী সে দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। পরের দিন ওর ডেলিভারি। ফ্লোরে গিয়ে খবর পেলাম, দেবোত্তম ছুটিতে। কোভিড! এ দিকে, আমরা তো সব ফ্লোরে, মেকআপের ঘরে দেদার আড্ডা মারি, একসঙ্গে কাটাই। আমার তো ভয়ে প্রাণ উড়ে যাওয়ার অবস্থা! আমার যা হয় হোক, মধুবনীর যদি কিছু হয়? আমার বাচ্চাটার যদি কোনও ক্ষতি হয়ে যায়? দলের সবাই মিলে আমায় সাহস জুগিয়েছিল তখন। আর দেবোত্তম, স্বাদ-গন্ধ পাচ্ছে না বুঝেই তড়িঘড়ি ও নিজেকে আলাদা করে ফেলেছিল। আমার আর মধুবনীর কথা ভেবে শ্যুটিং থেকে ছুটি নিয়ে তড়িঘড়ি কোভিড পরীক্ষাও করায়। আমার আর মধুবনীর তাই কোনও বিপদও হয়নি। কোভিড পরীক্ষা নেগেটিভ এল আমাদের। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
প্রশ্ন: আপনাদের এই মিলমিশটাই কি পর্দায় ফুটে ওঠে?
একদমই। ‘খড়কুটো’-র দলটা এখন একটা পরিবারের মতো। আমি, দেবোত্তম, অম্বরীশদা, এবং বাকিরা সবাই সবার ভীষণ বন্ধু। তাই ক্যামেরার সামনে অভিনয় করতে হয় না। হাসি, ঠাট্টা, মজাগুলো একেবারে ভিতর থেকেই আসে। ‘খড়কুটো’ এমনিতেই আর পাঁচটা ধারাবাহিকের চেয়ে একেবারে অন্য স্বাদ নিয়ে পর্দায় এসেছিল। করোনার উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার দিনগুলোতে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ার আরামের মতো। পরিবারের সবকটা চরিত্র আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ, সবাইকে নিয়ে গল্প এগোচ্ছে, ধারাবাহিকের টাইটেল কার্ডে শুধু নায়ক-নায়িকা নয়, গোটা পরিবারের ছবি— এই সবগুলো ক্ষেত্রেই কিন্তু খড়কুটো একটা নতুন ধারা তৈরি করেছে বলা যায়।
প্রশ্ন: ‘ভালবাসা ডট কম’-এ আপনি ছিলেন ‘ওম’। বারো বছর পরে ‘খড়কুটো’য় আপনি ‘রূপাঞ্জন’। কিছু বদলেছে?
‘ওম’ আমার প্রথম বড় চরিত্র এবং সিরিয়াস ছেলে। ‘রূপাঞ্জন’ প্রথম আদ্যন্ত কমেডি চরিত্র। পাশের বাড়ির হাসিখুশি, আমুদে ছেলের মতো। কিন্তু দু’জনেই আমার খুব কাছের। মাঝে ‘কোজাগরী’, ‘ছদ্মবেশী’-সহ আরও কাজ করেছি। তবু এই দুটো চরিত্র আমায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় করেছে। তবে আমায় আর মধুবনীকে কিন্তু এখনও মানুষ ‘ওম’ আর ‘তোড়া’ বলেই চেনে। ‘ভালবাসা ডট কম’-এর বারো বছর পরেও স্টেজ শো, যাত্রা— যেখানেই যাই, ওটাই এখনও আমাদের পরিচয়। টিন এজ প্রেমের গল্প তো! দর্শক ভালবেসে ফেলেছিলেন।
প্রশ্ন: স্টেজ শো, যাত্রা এখনও করেন নিয়মিত?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ২০১২ থেকে কোভিডের আগে পর্যন্ত নিয়মিত করেছি। স্টেজ শো-যাত্রা মিলিয়ে বছরে পঞ্চাশটা শো তো বটেই, কখনও কখনও একশোর কাছাকাছি। করোনার ভয়ে সব বন্ধ। গত দু’বছরে একটাও করিনি। কোভিড পরিস্থিতি কাটলে আবার শুরু করব। ছেলেটাও একটু বড় হয়ে যাবে। আশা করি মধুবনীও ধারাবাহিকের অভিনয়ে ফিরতে পারবে। স্টেজ শো বা যাত্রা তো সারা রাতের ব্যাপার। সেটা ও এখনই পেরে উঠবে না অবশ্য।
প্রশ্ন: যাত্রা আর ধারাবাহিক, দুটো একেবারেই আলাদা রকমের অভিনয়। একসঙ্গে চালিয়ে যেতে অসুবিধা হয় না?
এখনও পর্যন্ত তো হয়নি। ধারাবাহিক লোকে দেখে, যাত্রা কিন্তু আসলে শোনে। ভেবে দেখুন, সামনের কয়েকটা সারি বাদ দিয়ে পিছনেও হাজার হাজার দর্শক থাকেন। তারা কিন্তু দূর থেকে আমাদের চেহারা বুঝতে পারেন না। কানে শুনে আমাদের অভিনয় উপলব্ধি করেন। তাই যাত্রা করাটা, কণ্ঠস্বরকে ইমোশন অনুযায়ী বদলে নেওয়াটা একেবারে অন্য রকম একটা চ্যালেঞ্জ। একটা সংলাপ ভাল বললে সঙ্গে সঙ্গে হাততালি পড়ে। লাইভ ফিডব্যাক পাওয়ার স্বাদটাই আলাদা। সেখানে ধারাবাহিকে চোখ-মুখের ভাষা, আচরণে অভিনয় ফুটিয়ে তোলাটা আবার অন্য ধারার, অন্য স্বাদের কাজ।
প্রশ্ন: আপনি আর মধুবনী। পর্দার ‘ওম-তোড়া’ এখন বাস্তবের স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা। ‘ভালবাসা ডট কম’ই কি আপনাদের ভালবাসায় অনুঘটক হয়ে দাঁড়াল?
হ্যাঁ আলাপ তো ওখানেই। ভাল লাগাও। তার পরে একসঙ্গে দীর্ঘ দিন স্টেজ শো, যাত্রা সবই করেছি। তবে প্রোপোজ কিন্তু মধুবনী করেছিল! এক শীতের রাতে মেদিনীপুরে যাত্রা করে ফিরছিলাম আমরা। হাইওয়েতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রুটি-তরকা খেতে খেতে মধুবনী বলল, ও আমায় ভালবাসে। আমিও তো পছন্দই করতাম। আগে বলা হয়ে ওঠেনি।
প্রশ্ন: প্রেমিকা থেকে স্ত্রী। পাঁচ বছর পরে এখন আপনার সন্তানের মা। মধুবনী কি পাল্টেছেন? আপনাদের বিশ্বাসের ভিতটা কি আগের মতোই পোক্ত?
আমরা তো বন্ধু ছিলাম। এখনও আগের মতোই দারুণ বন্ধুত্ব। বারো বছরে একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস এতটুকু টাল খায়নি। স্বামী-স্ত্রী অনেক সময়েই শুনি একে অন্যকে সন্দেহ করে। সেখানে আমাদের মধ্যে সন্দেহ দূরে থাক, একে অন্যের ফোন ঘেঁটে দেখার কথাও মাথায় আসেনি কখনও। তবে হ্যাঁ, মধুবনী খানিক বদলেছে বটে। আগে কোনও কিছুতেই মাথা ঘামাত না তেমন। বিয়ের পরেও না। জায়গার জিনিস বেজায়গায় পড়ে থাকলেও খুব একটা কিছু যেত আসত না ওর। বরং আমি ওর চেয়ে বেশি গোছানো। কিন্তু মা হওয়ার পরে ইদানীং দেখি সব দিকে ওর নজর বেড়েছে। আগের চেয়ে সাবধানও হয়েছে অনেক।
প্রশ্ন: ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে আপনারা তো বেশ সক্রিয়। ছেলেকে নিয়ে ইউটিউব চ্যানেলও খুলে ফেলেছেন। কেন?
দেখুন, দর্শকই আমাদের তারকা বানিয়েছেন। তাই তাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়াটা, তাঁদের সঙ্গে মেশাটা আমাদেরও কর্তব্য, জরুরিও বটে। নেটমাধ্যম সেই কাজটা অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। ইদানীং ছেলেকে নিয়ে ইউটিউবে এই ভ্লগিংটা আমরা নিজেরাই খুব উপভোগ করি। কেশবকেও মানুষ দেখতে পান, আশীর্বাদ করেন। আর ইদানীং এই ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-টুইটারে টলিউড-বলিউড সবারই নজর থাকে। সেটাও পেশার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক।
প্রশ্ন: বলিউডে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
(হাসি) বলিউডে কাজ করার লক্ষ্য নিয়েই তো কেরিয়ার শুরু করেছিলাম। মডেলিং করতাম মুম্বইয়ে। সেখান থেকে এক বার কলকাতায় এসে ‘চ্যাম্পিয়ান’ ধারাবাহিকের অডিশন, সুযোগ পেয়ে গেলাম। সেই আমার প্রথম কাজ। তিন-চার বছর আগে হলে বলতাম, বলিউডে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। কিন্তু এখন এই ওটিটি আর অন্য ভাষায় ডাবিং করা ধারাবাহিক-সিরিজের জমানায় যেখানেই কাজ করি না কেন, ভাল অভিনয় করলে দর্শক ঠিকই দেখবেন। তাই হিন্দিতে কাজ করতেই হবে, সেটা বোধহয় আর আবশ্যিক নয়।