উত্তমকে আবিষ্কার করতে কত সময় নিয়েছেন বিভাস?
তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উত্তমকুমার। আর যৌবনের সরণিতে নাট্যকার তথা অভিনেতা বিভাস চক্রবর্তী। বার্ধক্যে দাঁড়িয়ে বিভাস এখন নিজেই বলেন, ‘‘উন্নাসিক ছিলাম তখন। সে সময়ে উত্তমের বেশির ভাগ ছবিই মনে হত, বাতিলের খাতায় দেওয়ার মতোই।’’ শুধু কি তাই? উত্তমকুমারকে অভিনেতা হিসেবেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাননি শুরুতে। বরং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় জগতে আসার পর থেকে তাঁকেই ভাল লাগত। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিভাসই নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন উত্তমকে। কেন তিনি নায়ক, কেন তাঁর এই কালোত্তীর্ণ বিপুল জনপ্রিয়তা, সেটা বুঝতে সময় লেগেছিল অনেকগুলো বছর।
উত্তমকুমারের মৃত্যুবার্ষিকীতে নিজের যৌবনকেও যেন ফিরে দেখলেন বিভাস। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন এক নায়ক আবিষ্কারের গল্প। বিভাসের কথায়, “শুরুতে উত্তমকুমারকে মনে স্থান দিইনি। পরে যখন বয়স বাড়ল, ছবির জগৎ নিয়ে আর একটু তলিয়ে ভাবলাম, তখন উত্তমকুমারকে নিয়েও আমার ধারণা বদলে গেল। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ছবি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন ভাবতে বসলাম, ওঁর অভিনয়ের ধারাটা আরও যেন কাছাকাছি এল। উপলব্ধি হল, উত্তমকুমার বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। নানা ধরনের অভিনয়ে তাঁর পারদর্শিতা। বিশেষত প্রেমিকের ভূমিকায়, রাজার ভূমিকায় তাঁকে মানায় তো বটেই, কিন্তু হাসির চরিত্রেও তিনি অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ওঁর অভিনয়ের আঙ্গিক মুগ্ধ করেছে আমাকে। এখন মনে হয়, উত্তমকুমারের মতো অভিনেতা খুব কমই আছেন।”
বাংলা ছবির চিরকালীন তারকার কথা বলতে বলতে তুলনা চলে আসে থিয়েটার নিয়েও। বিভাস জানান, আন্তর্জাতিক অভিনয়ের ব্যাকরণ মেনে যে মেথড অ্যাক্টিংয়ের ধারণা প্রচলিত, বড় অভিনেতারা অনেক সময়েই সেটা অনুসরণ করেননি। স্বভাবজাত সারল্য নিয়ে নিজস্ব ধারায় অভিনয় করেছেন। সামনে কোনও অনুপ্রেরণা ছিল না। সেই দলেই পড়েন উত্তম। প্রবীণ নাট্যশিল্পীর মতে, আন্তর্জাতিক ছবি দেখার অভ্যেস তৈরি হয়ে গেলে সৌমিত্রকে বাংলার সেরা অভিনেতা বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তিনিও যে মেথড অ্যাক্টিংই করতেন। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও আন্তর্জাতিক ছবির ঘরানায় আকৃষ্ট ছিলেন, তাই সৌমিত্রই তাঁর চাহিদামতো অভিনয় উপস্থাপন করতে পারবেন, এতে আর সন্দেহ কী! কিন্তু যখন ‘নায়ক’ তৈরি করছেন, তখন তো সত্যিকারের নায়কই প্রয়োজন। সে চাহিদা মেটাতে পারতেন কেবল উত্তম। সত্যজিৎও আসল নায়ককেই ‘নায়ক’-এ ব্যবহার করলেন।
উত্তমের অভিনয়-সফরেও কি কোনও বদল দেখেছিলেন নাট্যকার? বিভাসের কথায়, “একটা বিষয় লক্ষ করেছি। শুরুতে মানুষের মনে নায়কের ভাবমূর্তি তৈরির দিকেই যেন তাঁর ঝোঁক বেশি ছিল। কিন্তু পরে যখন নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন, তখন চরিত্রগুলোর আরও কাছাকাছি যেতে চাইছিলেন যেন। যে চরিত্রগুলো করেছেন, সেগুলোকে আরও বেশি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। শুরুতে নায়কোচিত যে বিশেষ ভঙ্গিগুলোর আশ্রয় নিতেন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য, প্রায় মুদ্রাদোষের মতো, পরের দিকে সেগুলো পরিহার করে তাঁকে চরিত্র হয়ে উঠতে দেখেছি।”
তবে বিভাসের মতে, দর্শকরাই সেরা বিচারক। তাঁরা বুঝতে পারেন কখন অভিনেতা কৃত্রিম ভাবে কথা বলছেন, কৃত্রিম অভিনয় করছেন বা অঙ্গভঙ্গিতে জড়তার কারণে চরিত্রটাও কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে। কাহিনির মধ্যে, ওই পরিবেশের মধ্যে চরিত্রটা যে ভাবে ফুটে ওঠা উচিত, সে ভাবে হচ্ছে না— সে-ও সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে তাঁদের চোখেই। টেকনিক্যাল চর্চা না থাকলেও সঠিক অভিনয় ঠিক চিনে নেন দর্শক। আর তাই উত্তম নায়ক। তাঁর জনপ্রিয়তার উপলব্ধি করতে চেয়ে বিভাস নিজেও তাই কখনও কখনও নিছক দর্শক হয়ে থেকেছেন।