অতিমারি কাটিয়ে ফের কাজে ব্যস্ত হতে পেরে দারুণ খুশি আবীর চট্টোপাধ্যায়। ছবি: ফাইল চিত্র
পুজোয় মুক্তি পাচ্ছে ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত সফল সিরিজের তৃতীয় অভিযান ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’। বড় পর্দায় ফিরছে সোনাদা-আবীর-ঝিনুক। পুজোয় এ বার মানুষ ফের ব্যস্ত থাকবেন, ভেবেই খুশি ছবির নায়ক। অতিমারির স্তব্ধতা কাটিয়ে রাস্তাঘাটে ট্র্যাফিক জ্যাম দেখলে আজকাল তিনি খুশি হন। চান চুটিয়ে কাজ করতে। নতুন ছবি মুক্তির আগে খোলামেলা আড্ডায় আবীর চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: ব্যোমকেশের পর ফের এক সফল ফ্র্যাঞ্চাইজির মুখ হয়ে উঠেছেন আপনি।
আবীর: একটা সময় অনেকের আমার বিরুদ্ধে রীতিমতো অভিযোগ ছিল যে, আমি ফ্র্যাঞ্চাইজি ছাড়া কাজ করি না। তার পর অবশ্য দেখলাম, তারা নিজেই উঠে পড়ে সব ফ্র্যাঞ্চাইজির সব ছবি করছে (হাসি)। ফ্র্যাঞ্চাইজির একটা মজা রয়েছে। দর্শক আশা করেন প্রথমের চেয়ে দ্বিতীয়টা বেশি ভাল হবে, দ্বিতীয়ের চেয়ে তৃতীয়টা। সেটা একটা মজার চ্যালেঞ্জ।
প্রশ্ন: কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি সফল হয়ে গেলে তো আবার বাড়তি চাপ?
আবীর: বাচ্চারা আমায় এত তাড়াতাড়ি ‘সোনাদা’ বলে ডাকা শুরু করবে ভাবিনি। আসলে ব্যোমকেশ তো বাচ্চারা ঠিক বোঝে না। তাই ওদের কাছে সোনাদাই পরিচিত। এই সিরিজটা আট থেকে আশি সকলের জন্য। তাই তৃতীয় ছবি নিয়ে একটা প্রত্যাশা নিশ্চয়ই সকলের আছে। সেটার তো একটা বাড়তি চাপ থাকেই। তবে সোনাদার একটা মজা আছে। সাহিত্যে সোনাদার কোনও ভিত নেই। সেটা কিন্তু বাংলায় খুব কম ফ্র্যাঞ্চাইজির ক্ষেত্রেই হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এত ভাল ভাল উপাদান আছে যে পরিচালকরা সাধারণত সেগুলো নিয়েই কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
প্রশ্ন: আপনার ফ্র্যাঞ্চাইজির ছবিগুলো যত সাফল্য পায়, বাকি সব ছবি দর্শকের মন সে ভাবে হয়তো ছুঁয়ে যায় না। এটা আপনাকে ভাবায় না?
আবীর: অবশ্যই ভাবায়। আমি তো মাঝে মাঝে ভাবি, বাঙালি কি তা হলে থ্রিলার ছাড়া আর কিছুই দেখে না! অথচ আমার ভীষণ ভাবে মনে হয় যে, এখন কিছু মিষ্টি ছবি, প্রাণ খুলে হাসার ছবি বা মজা পাওয়ার মতো ছবি হওয়া উচিত। এই অতিমারির ভয়াবহতা কাটিয়ে যা দেখে মানুষ একটু প্রাণ খুলে হাসবে, সে রকম ছবি হওয়া উচিত। কিন্তু আমি যদি সারা ক্ষণ থ্রিলারে অভিনয় করে যাই, তা হলে সেটা আর হবে কী করে!
প্রশ্ন: তেমন ছবি হচ্ছে না কেন? লেখকের অভাবে?
আবীর: লেখকের অভাব আছে কি না, সেটা তো দুম করে বলা যায় না। তবে আমার মনে হয়, আরও বেশি সংখ্যক লেখক ইন্ডাস্ট্রিতে এলে ভাল হয়। কারণ এই মুহূর্ত ভাল চিত্রনাট্যই আসল। তার উপর অন্য কোনও কিছুই খাটে না।
প্রশ্ন: সপরিবারে উপভোগ করার মতো ছবি যখন পুজোয় মুক্তি পায়, তখন অন্য ছবিগুলোর চেয়ে কি বক্স অফিসের নিরিখে এমনিই এগিয়ে থাকে?
আবীর: তেমনটা ভাবা বোকামি। একটা প্রতিযোগিতা তো থাকবেই। আপনার মতো যাঁরা আমায় বহু দিন ধরে চেনেন, তাঁরা জানেন, আমার মধ্যে একটা প্রতিযোগী মানসিকতা রয়েছে। কিন্তু সেটা সুস্থ প্রতিযোগিতা। ইন্ডাস্ট্রিতে আমি এখন যে জায়গায় রয়েছি, তাতে সকলেই আমার কাছ থেকে একটা ইতিবাচক মনোভাব আশা করেন। আর সেটা থাকাও উচিত। তাই এর ছবি চলবে, ওর ছবি চলবে না, সেটা আমি বলতে পারি না। তবে দর্শকও খুব বুদ্ধিমান। তাঁদের আগে থেকেই মনের মধ্যে একটা ভাবনা থাকে, কোন ছবি দেখবেন, কোনটা দেখবেন না। তাই এ সব সিদ্ধান্ত তাঁদের উপর ছাড়াই ভাল। আমরা খালি নিজেদের কাজটা (অভিনয় এবং প্রচার) ঠিক মতো করতে পারি। তবে সব ছবি একসঙ্গে যদি হল-এ দর্শক টানতে পারে, তা হলে সেটা ইন্ডাস্ট্রির জন্যেও ভাল। অতিমারিতে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। দর্শকের ছবি দেখার ধরন বদলে গিয়েছে। এখন আবার সব স্বাভাবিক হচ্ছে যখন, তখন একটা ভাল ছবি, একটা ভাল গান বা একটা ভাল নাটক সকলের জন্যেই খুব জরুরি।
‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ ছবিতে ইশা সাহা, আবির চট্টোপাধ্যায় এবং অর্জুন চক্রবর্তী (বাঁ দিক থেকে)। ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন: দর্শকের ছবি দেখার অভ্যাস বদলে যাওয়াটা কি ইন্ডাস্ট্রির জন্য চিন্তার বিষয়?
আবীর: ওটিটির আগে কেব্ল টিভি ছিল, স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল। দর্শক কিন্তু তখনও ঠিক করতেন কোনটার টিভিতে দেখার অপেক্ষা করবেন, কোনটা হল-এ গিয়ে দেখে আসবেন। তবে এখন তাঁদের অভ্যাস অনেকটা বদলে গিয়েছে। ওটিটি-তে নানা রকমের কনটেন্ট রয়েছে। কোনটা কখন দেখবেন, কোথায় বসে দেখবেন, কতটা দেখবেন— সব কিছুই নিজের স্বচ্ছন্দ মতো বেছে নিতে পারেন। তাই আমরা হলে আসার জন্য অনুরোধ করতে পারি মাত্র।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় ওটিটি-তে আজকাল সব ছবি বড্ড তাড়াতাড়ি চলে আসছে?
আবীর: মানুষ তো অতিমারি আগে কখনও দেখেননি, এই প্রথম দেখলেন। এর প্রভাব সকলের উপর কী ভাবে পড়েছে, সেটা কিন্তু সবটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিও তেমনই একটা বদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাই কোনটা ঠিক হচ্ছে, কোনটা ভুল এগুলো এখনই বলার মতো সময় আসেনি। সকলেই সময়টা বুঝতে চাইছেন।
সোনাদার একটা মজা আছে। সাহিত্যে সোনাদার কোনও ভিত নেই। সেটা কিন্তু বাংলায় খুব কম ফ্র্যাঞ্চাইজির ক্ষেত্রেই হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন: এই অনিশ্চিত সময় তো শিল্পীদের জন্য খুবই কঠিন?
আবীর: দু’সপ্তাহ আগে মুম্বই যাচ্ছিলাম। আমি বোধহয় অনেক দিন পর মানুষকে বিমানবন্দরে নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে দেখলাম। অতিমারির একদম মাঝে ‘অবরোধ টু’-এর শ্যুটিংয়ের জন্য আমায় অনেক বার সফর করতে হয়েছে। সে সময়ে এমন ভাবে কাজ হয়েছে যে, পরিচালকের সঙ্গে আমি কোনও দিনই বসে কথাই বলিনি। অথচ অতগুলো লোকেশনে, এত কলাকুশলী নিয়ে দিব্যি একটা গোটা সিজনের শ্যুটিং হয়ে সেটা ওটিটি-তে মুক্তিও পেল, দর্শক দেখলেনও। এখন ভাবতেও অবাক লাগে! দর্শকের যেমন ছবি দেখার অভ্যাসে বদল আসছে, আমাদেরও কাজে বদল আসছে। শিল্পী হিসাবে সেগুলো অবশ্যই ভাবায়। তবে এই বদলগুলোর সঙ্গে না মানিয়ে চলতে পারলে তো এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়।
প্রশ্ন: আপনার সমসাময়িকরা অনেকে এখন নিজের প্রযোজনা সংস্থা খুলে ফেলেছেন। সকলকেই প্রযোজকের ভূমিকা নিতে হচ্ছে কেন বলুন তো?
আবীর: ছবি তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকাটা কিন্তু একটা অন্য অভিজ্ঞতা। অনেক সময়ই কোনও গল্প শুনে মনে হয়েছে, আমি যদি এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি, এটার পাশে দাঁড়াতে পারি বা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, তা হলে দারুণ হয়! মনে হয় আমার বন্ধুরা সকলে সেই ভাবনা থেকেই প্রযোজকের ভূমিকাটা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে আমায় অনেকে তাদের ছবিতে অভিনয়ও করতে বলছে। সেটা আবার আমার জন্য বেশ ভাল (হাসি...)।
প্রশ্ন: আপনার তেমন পরিকল্পনা নেই?
আবীর: মিথ্যে কথা বলব না, মাঝে মাঝে আমারও ইচ্ছা হয়েছে। কিছু দিন আগেই আমার এক পরিচালক বন্ধু একটা গল্প শোনাল। আমি সেখানে অনেক রকম পরামর্শ দিলাম। এই মুহূর্তে আমার কাছে তেমন ডেট নেই বলে অপেক্ষাও করতে বললাম। পরে বললাম, আমার বদলে যদি অন্য কেউ ওই চরিত্রে অভিনয় করে, আর আমি ছবি তৈরির কাজের সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত থাকতে পারি, তা হলে দারুণ হবে। এ রকম অনেক ছবির ক্ষেত্রেই মাঝে মাঝে মনে হয়। প্রযোজনা নিয়ে চিন্তাভাবনা নিশ্চয়ই করব।