অভিষেককে নিয়ে লিখলেন প্রতীক
বাবা নেই! গলার কাছে কান্না যেন দলা পাকিয়ে উঠছে। একটু করে কথা বলছেন আর অঝোরে কাঁদছেন প্রতীক সেন। ধারাবাহিক ‘মোহর’-এ ‘আদি রায়চৌধুরী’ ওরফে অভিষেক চট্টোপাধ্যায় বাবা। ছেলে ‘শঙ্খ রায়চৌধুরী’ ওরফে প্রতীক সেন। বাকিটা তাঁর লেখনিতে...
বুধবারেও স্টুডিয়োয় অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। স্টার জলসার রিয়্যালিটি শো ‘ইসমার্ট জোড়ি’-তে তিনি আমন্ত্রিত। সকাল থেকে টানা শ্যুট করছেন। আচমকাই অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছু ওষুধ তাঁকে খাওয়ানো হল। কিন্তু শারীরিক অবস্থার কোনও উন্নতি নেই। শেষে দাদা বললেন, আমি আর পারছি না। আজ বাড়ি যাই। একটুও দেরি না করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। বৃহস্পতিবার ‘মোহর’-এর কল টাইম দিয়ে দেওয়া হল। বললাম, কাল কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার বড় দৃশ্য আছে।
অভিষেক চট্টোপাধ্যায় নেই। খবরটা জানার পরেই পায়ের তলার মাটি যেন দুলে উঠল। সকাল হতেই ওঁর বাড়িতে গেলাম। আমি যে শুধু পর্দায় নয়, বাস্তবেও ওঁর ছেলেই ছিলাম! বাড়িতে তখন ওঁকে ঘিরে লাবণি সরকার, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী হালদার-সহ আরও অনেকে। হাউহাউ করে কাঁদছেন সবাই। তার মধ্যেই সবাই বললেন, “তুই ওর ছেলে ছিলিস। বাবাকে নিজের হাতে সাজিয়ে দে।” পোশাক পাল্টে ওঁকে নতুন করে সাজালাম। শেষ বারের মতো রাজার মতো সেজে উঠলেন আমার বাবা।
স্থানীয় কাউন্সিলর এসেছিলেন। আমি থাকতে থাকতেই পৌঁছেছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। মরদেহ রাখা হবে টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োয়। জানি, আজ দিনের আলোতেই মাটিতে তারার ঢল। কিন্তু অন্য দিনের তো তাঁরা ঝিকমিক করে উঠবেন না। মাত্র ৫৭-র অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের শোকে সবাই আমার মতোই অঝোরে ঝরবেন। আজ যেন বেশি করে মনে পড়ছে অতীত। ৪৫ বছর বিনোদন দুনিয়াকে কাঁধে করে যে চার সুপারস্টার বহন করেছেন, অভিষেক চট্টোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী, তাপস পাল, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আর অভিষেকদা। তাপস পালও অসময়ে চলে গেলেন। এ বার অভিষেকদাও!
দাপিয়ে বড় পর্দায় অভিনয় করেছেন। নানা কারণে একটা সময়ের পরে সরে এসেছেন। সেই ক্ষোভ কথায় কথায় প্রকাশও করে ফেলতেন। বলতেন, ‘‘আরও অনেক ভাল চরিত্রে অভিনয় করা বাকি থেকে গেল রে প্রতীক। সুযোগই পেলাম না!’’
সেই অভাব তিনি সুদে-আসলে পুষিয়ে নিয়েছিলেন ছোট পর্দায়। শুধু ‘মোহর’ বা ‘খড়কুটো’ নয়। ‘টাপুর টুপুর’, ‘ইচ্ছে নদী’, ‘কুসুম দোলা’, ‘ফাগুন বউ’ এবং আরও যে ক’টি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন, সব ক’টিই জনপ্রিয়। পর্দায় বাবা হিসেবে অতুলনীয় ছিল। ‘মোহর’-এ আদি-অদিতি জুটির জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনও কথা হবে না! অভিষেকদা আর অনুশ্রী দাস মাতিয়ে রাখতেন সেট। দাদা খুব মজার মানুষ ছিলেন। প্রচণ্ড হুল্লোড় করতেন। খেতে খুব ভালবাসতেন। একসঙ্গে সবাইকে নিয়ে বসে খেতেন। শ্যুটের আগে শট নিয়ে আলোচনা করে নিতেন। তার পর ক্যামেরার মুখোমুখি হতেন। এক ফোঁটা অহঙ্কার ছিল না।
কত সময়ে পিছনে লাগতাম, এত সুন্দর দেখতে তুমি। ক’টা প্রেম করেছ? হাসতে হাসতে বলতেন, “অনেকগুলো! তবে সংযুক্তাকে বিয়ের পরে আর প্রেম করিনি।” আমাদের নিয়ে কোনও গুঞ্জন ছড়ালে যখন অস্বস্তিতে পড়তাম, দাদা বলতেন, ‘‘একটুও ভয় পাবি না। আমি ভয় পাই না। আমার কিচ্ছু লুকনো নেই। ফলে, আমার ভয়ও নেই।’’ খুব কিন্তু অনিয়ম করতে দেখিনি কোনও দিন। চেন স্মোকার ছিলেন। ওটা নিয়ে একটু সাবধান করতাম। প্রথম কথাই হত আমাদের, ‘‘তুমি কি ধূমপান কমিয়েছ?’’ সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়িয়ে বলতেন, ‘‘হ্যাঁ রে, অনেক কমিয়ে দিয়েছি।’’ বাবা তো নয়, যেন প্রিয় বন্ধু!
আজ তাঁকে বিদায় জানানোর দিন। কী ভাবে সেই যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করি। তথ্য সংস্কৃতি দফতর থেকে জানানো হয়েছে, কেওড়াতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। সেখানেই তাঁকে শেষ শ্রদ্ধাও জানানো হবে। খুব ইচ্ছে, যে মানুষ শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা বিনোদন দুনিয়াকে বহন করে গেলেন, তাঁর শেষযাত্রায় আমিও তাঁকে কাঁধ দেব।
বাবাকে শেষ বারের মতো এগিয়ে দেওয়া তো ছেলেরই কর্তব্য...।