সইফ আলি খানের সঙ্গে অটোচালক ভজন সিংহ রানা। ছবি: সংগৃহীত।
পরিসংখ্যান বলছে ২০২৩ সালে মুম্বই শহরে অটোচালকের সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ২০ হাজার। গত এক বছরে সেই সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে বেড়েছে। আর এই মুহূর্তে সারা দেশে সম্ভবত সবচেয়ে চর্চিত বিষয় মুম্বইয়ের অটো। যাঁর জন্য এই খ্যাতি, তাঁর নাম— ভজন সিংহ রানা।
গত ১৬ জানুয়ারি ভোরে রক্তাক্ত সইফ আলি খানকে বান্দ্রার বাড়ি থেকে লীলাবতী হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন ভজন। এক প্রকার ‘নতুন জীবন’ই উপহার দিয়েছিলেন পটৌদীর ‘ছোটে নবাব’কে। কিন্তু ওই রাতই বদলে দিয়েছে ভজনের জীবন। কতটা বদলে গেল অটোচালকের জীবন? জানতে চেয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন।
বুধবার সকাল থেকে ভজনের ফোন ব্যস্ত। ফোন বাজলেও ধরছেন না। তিনি কি অটো চালাচ্ছেন! সাবধানতার কারণে ফোন ধরছেন না? জানার উপায় নেই। তবে বুধবার রাত প্রায় সাড়ে ১০টায় ফোন ধরলেন ভজন। দিনের শেষে সবে বাড়ি ফিরেছেন। প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর ফোনের ও পার থেকে ক্লান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘‘আমি সাক্ষাৎকার দিতে চাই না। যা বলার আগেই সব বলে দিয়েছি। আর সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে দয়া করে দেখা করুন। কে কোথা থেকে ফোন করছে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। মুখোমুখি কথা বলব।’’ জানালেন, গত কয়েক দিনে লাগাতার গণমাধ্যমের চাপ তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। তাঁর ছবি ব্যবহার করে নেটদুনিয়ায় অজস্র ‘ফেক ভিডিয়ো’ ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তিনি। দুটো কথা জানিয়েই ফোন রাখার উপক্রম করলেন ভজন। সইফ নন, যদি শুধু তাঁকে নিয়ে দু’টি প্রশ্ন করা হয়, উত্তর দেবেন তিনি? কিছু ক্ষণ চুপ থাকার পর রাজি হলেন আদতে উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা ভজন সিংহ রানা।
উত্তরাখণ্ডের খটীমা শহরে বড় হয়েছেন তিনি। মুম্বইয়ে প্রায় ২০ বছর অটো চালাচ্ছেন ভজন। থাকেন খার অঞ্চলে। প্রতি দিনের মতো ১৫ জানুয়ারি রাতেও গিয়েছিলেন বান্দ্রা অঞ্চলে, ভাড়ার সন্ধানে। তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। মঙ্গলবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে ভজনের সঙ্গে দেখা করেন সইফ। বুধবার দু’জনের একসঙ্গে তোলা সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে সমাজমাধ্যমে। ভজন বললেন, ‘‘জানি না কী ভাবে ছবিগুলো ভাইরাল হয়েছে। তার পর থেকে আরও সকলে বিরক্ত করছেন। আমি একটু বিশ্রাম চাই।’’ দেশের বাড়ি থেকেও একের পর এক ফোনে জেরবার ভজন।
ভজন জানতেন না, যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তিনি হাসপাতালে নিয়ে চলেছেন, তিনি সইফ আলি খান। ভবিষ্যতেও কি এই ভাবেই তিনি কারও বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িতে দেবেন? হেসে বললেন, ‘‘কেন করব না? অবশ্যই করব। ধনী বা গরিব— এই বিভাজন না রেখেই মানুষকে সাহায্য করা উচিত।’’ ভজন কোনও দিন কলকাতায় আসেননি। তবে কলকাতার হলুদ ট্যাক্সির কথা জানেন, নির্দিষ্ট রুটে অটোর কথাও শুনেছেন। শহরে বিভিন্ন কারণে ট্যাক্সি বা অটোচালকদের সমালোচনা যেমন হয়, তেমনই তাঁদের ভাল কাজের প্রশংসাও করা হয়। এই মুহূর্তে ভজন তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কথাপ্রসঙ্গেই তাঁর ‘বাঙালি ভাই’দের প্রতি বার্তা দিলেন ভজন। বললেন, ‘‘মানুষকে সাহায্য করুন। হয়তো কোনও পথদুর্ঘটনা হয়েছে, দেখি অনেক চালক ভয় পেয়ে যান। ভয় পাবেন না। কাউকে সাহায্য করার পর দেখবেন, নিজেরই মনটা আনন্দে ভরে উঠেছে।’’
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
এক রাতের ঘটনায় তাঁর নামের সঙ্গে ‘তারকা’ তকমা জুড়ে গিয়েছে। জীবন কি বদলে গিয়েছে তাঁর? ভজন বললেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমে যা বলা হচ্ছে, মানুষ দেখছেন। আমি কোনও তারকা হতে চাই না। আমার যা করার সেটা করে দিয়েছি।’’ সমাজমাধ্যমে চর্চা, সইফ নাকি ভজনকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু ভজন এ রকম গুজবকে উড়িয়ে দিলেন। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সইফের হাত ধরেই আরও সুরক্ষিত পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। ভজন তা করেননি। বললেন, ‘‘আমি তাঁর থেকে কিছু চাইনি। কিছু অনুরোধ করার চেষ্টাও করিনি। উনি খুশি হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। আর কী চাই!’’
তাঁর কাজের প্রশংসাস্বরূপ ইতিমধ্যেই মুম্বইয়ের একটি সংস্থা ভজনকে ১১ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, হাসপাতালে দেখা হওয়ার পর সইফের পরিবার তাঁর হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছে। কিন্তু টাকার প্রসঙ্গ উঠতে ভজন চুপ করে গিয়েছেন, কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন তিনি। সইফের পরিবারের সদস্যেরা তাঁকে কী বলেছেন? প্রসঙ্গ তুলতেই ভজন বললেন, ‘‘আমি তারকা হতে চাই না। যা করেছি মানবিকতার খাতিরে। ওঁর পরিবারের সকলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাঁরা আমার প্রশংসা করেছেন। আর কিছু চাই না।’’ আর কোনও প্রশ্ন করা গেল না। ক্লান্ত ভজন রাতের খাবার খেতে বসবেন। আগামী কাল থেকে কী পরিকল্পনা তাঁর? বললেন, ‘‘আমি এ বার শুধু কাজে ফিরতে চাই।’’