অভিনেতা অনির্বাণ চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
দু’মাসে ছ’টা নতুন কাজের মুক্তি। ছবি থেকে ওয়েব সিরিজ়— সর্বত্র বিরাজ করছেন অনির্বাণ চক্রবর্তী। তবে নিজেকে ‘তারকা’ মনে করতে ঘোর আপত্তি তাঁর। জটায়ু থেকে একেন— নতুন বছরের শুরুতেই তাঁর ব্যস্ততা। সম্প্রতি এক সকালে কফির আড্ডায় মন খুলে কথা বললেন অনির্বাণ।
প্রশ্ন: নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছে গিয়েছেন। শুরু থেকেই কি আপনি এ রকম, না কি সময়ের সঙ্গে নিয়মানুবর্তিতা বেড়েছে?
অনির্বাণ: আমি বরাবরই এ রকম। ১৪ বছর চাকরি করেছি। গর্ব করে বলতে পারি, এক দিনও দেরিতে অফিস পৌঁছইনি। কখনও কখনও ফ্লোরে অন্য অভিনেতা দেরিতে পৌঁছেছেন। হয়তো বিরক্ত হয়েছি, একটু রাগ করেছি। কিন্তু আমার স্বভাব কখনও বদলায়নি।
প্রশ্ন: কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে তারকারা নাকি একটু দেরিতে পৌঁছতে পছন্দ করেন। তার ফলে নাকি তাঁদের স্টারডম বাড়ে!
অনির্বাণ: সবাই তো লেট করেন না! আর আমি তারকা নই। তাই ঠিক বলতে পারব না, তারকারা ঠিক কী ভাবে তাঁদের স্টারডম ধরে রাখেন। তবে দেরি করলে আমার মূল্য বাড়বে— এই ধারণায় আমি বিশ্বাসী নই (হাসি)।
প্রশ্ন: কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির একাংশ বলছে, আপনিই নাকি আসল তারকা। কারণ, ডিসেম্বরে আর কোনও অভিনেতার তিনটে কাজ একসঙ্গে মুক্তি পায়নি।
অনির্বাণ: একদম বাজে কথা। আমি নিজেকে একেবারেই কোনও তারকা মনে করি না। আচ্ছা, ডিসেম্বরে তো টোটারও (টোটা রায়চৌধুরী) দুটো কাজ মুক্তি পেয়েছে (হাসি)।
প্রশ্ন: কিন্তু দু’মাসে ছ’টা রিলিজ় তো এর আগে আপনার কেরিয়ারে কখনও ঘটেনি।
অনির্বাণ: একদম নতুন অভিজ্ঞতা। আসলে, গত দেড় বছর ধরে বিভিন্ন প্রজেক্টে অভিনয় করেছি। ঘটনাচক্রে সেগুলো এখন পর পর মুক্তি পাচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি কি এখন কেরিয়ারের সেরা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে হয়?
অনির্বাণ: (একটু ভেবে) সেটা আমি জানি না। মাত্র ছ’বছর ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছি। এর মধ্যে ছবি এবং সিরিজ় মিলিয়ে প্রচুর কাজের সুযোগ পেয়েছি। ইন্ডাস্ট্রির বাইরের একজন মানুষ হিসেবে সেটা কী ভাবে ঘটল, তা ভাবলে একটু অবাক লাগে।
প্রশ্ন: কী কারণে এটা সম্ভব হল, জানেন?
অনির্বাণ: আমি ঠিক জানি না। আমার ‘পিআর’ খুব খারাপ। মন দিয়ে শুধু নিজের কাজটা করেছি। তার বাইরে কোনও কিছুতে মন দিইনি। তাই হয়তো একের পর এক দরজা খুলে গিয়েছে। মন দিয়ে কাজ করলে যে সাফল্য আসে, আমিই তো তার প্রমাণ।
প্রশ্ন: ‘পিআর’ না করেও তা হলে ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকা যায় বলতে চাইছেন?
অনির্বাণ: এই নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কখনও আমার কথা হয়নি। আমি এটা না করে টিকে আছি, সেটা বলতে পারি। কিন্তু তার মানে কেউ যদি কারও সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তার মধ্যে আমি কোনও দোষ দেখি না।
প্রশ্ন: কাজের জন্য আপনাকে কখনও কাউকে ফোন করতে হয়েছে?
অনির্বাণ: না। যাঁদের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক, তাঁদের কাছে কখনও হয়তো কথা প্রসঙ্গে কাজের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছি। কিন্তু কাজের জন্য সিরিয়াস ভাবে অপরিচিত কাউকে কখনও ফোন করিনি।
‘পুরো পুরী একেন’ সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে (বাঁ দিক থেকে) সুহোত্র মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ চক্রবর্তী এবং সোমক ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: জটায়ু এ বার কাশ্মীরে। একেনবাবু পুরীতে। একটু অদলবদল হয়ে গেল যে।
অনির্বাণ: (হাসতে হাসতে) না না। সেই ভাবে ভাবতে গেলে, হয়তো যাঁরা আমার পূর্বসূরি, আমি তাঁদের জায়গাগুলো বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে ঘুরে ঘুরে দেখছি। জটায়ু তো একেনবাবুর থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ। তাই তিনি যেখানে যেখানে গিয়েছেন, এ বারে একেন সেই জায়গাগুলো ঘুরে দেখছে।
প্রশ্ন: আটটা সিরিজ় এবং দুটো ছবি। দশম একেন-এ সবচেয়ে বড় চমক কী?
অনির্বাণ: সেটা তো এখনই বলব না। প্রথম দুটো সিজ়ন ছাড়া একেনবাবুর ক্ষেত্রে আমরা কখনও তার গন্তব্য একই রাখিনি। তাই নতুন একেন মানে, একটা নতুন ঘোরার জায়গা। এমন একটা জায়গা,যার সঙ্গে বাঙালির একটা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। খাওয়াদাওয়া তো থাকেই। তার সঙ্গে রহস্য সমাধানের হাতছানি। সব মিলিয়ে একেন মানেই দর্শকের কাছে একটা ভাল প্যাকেজ।
প্রশ্ন: চরিত্রের পরিচিতির নিরিখে আপনার কেরিয়ারে একেনের পাল্লা ভারী। তার পর জটায়ু। এর বাইরে কোনও চরিত্রে অভিনয় করাটা কি কখনও কখনও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়?
অনির্বাণ: আপনি যে তিনটি কাজের কথা বলছিলেন, দর্শক কিন্তু সেগুলো দেখে বলেছেন যে প্রত্যেকটাই একে অপরের থেকে আলাদা। চ্যালেঞ্জ মনে করলে অভিনয় করা সম্ভব নয়। আমার কাছে কোনও চরিত্র এলে আমি প্রথমে তাকে বুঝতে চেষ্টা করি। সেই মতো চরিত্রটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আলাদা কিছু করতে হবে, বা নিজেকে হয়তো রিপিট করছি— এই বিষয়গুলো মাথায় না রাখার চেষ্টা করি। তাতে বিষয়টা সহজ হয়ে যায়।
ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: একেনের জন্য কি এখনও আপনাকে আলাদা করে কোনও প্রস্তুতি নিতে হয়?
অনির্বাণ: চরিত্রটা হয়তো আমার বেশি পরিচিত। পাশাপাশি, যে চরিত্রে আমি দশ বার অভিনয় করেছি, সেই চরিত্রে প্রত্যেক বার নতুন কিছু উপস্থাপন করাটাও একটা বড় দায়িত্ব। এক থেকেও আমাকে আলাদা হতে হয়।
প্রশ্ন: মুক্তির পর বাড়িতে একেন দেখেন?
অনির্বাণ: হ্যাঁ। দর্শকের মতো বার বার না হলেও এক বার তো দেখিই। বুঝতে পারি, কোথায় কী কী ভুল করেছি।
প্রশ্ন: এর আগে আপনি বলেছিলেন, যে দিন আর নতুন কিছু দেওয়ার থাকবে না, সে দিন একেনের চরিত্রকে বিদায় জানাবেন। এখনও একঘেয়েমি আসেনি তা হলে?
অনির্বাণ: না, আসেনি। এই সিরিজ়ে পুরীতে খুবই মজা করে শুটিং করেছি। কারণ, আমার একঘেয়ে লাগলে সেটা দর্শকও পর্দায় বুঝতে পারবেন। দর্শকের এত প্রিয় একটা চরিত্রের কোনও করুণ পরিণতি আমি চাই না।
প্রশ্ন: রাশিয়ায় একেনবাবুর ছবির শুটিংয়ের কোনও খবর?
অনির্বাণ: এখনও পর্যন্ত নতুন কোনও আপডেট নেই। গত বছর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। অন্য একটা দেশ। তার জন্য খুবই অন্য রকম একটা চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছে। আমার পড়ে খুব ভাল লেগেছে। দেখা যাক, কবে নতুন খবর আসে।
প্রশ্ন: আচ্ছা ধরা যাক, এই কলকাতা শহরেই অনির্বাণ চক্রবর্তীর সঙ্গে হঠাৎ জটায়ু এবং একেনবাবুর দেখা হল। তাঁরা আপনাকে কী বলতে পারেন। কখনও ভেবেছেন?
অনির্বাণ: (মুচকি হেসে) মুশকিলে ফেললেন। (একটু ভেবে) প্রথমত, তাঁদের সঙ্গে দেখা হলে আমার খুবই আনন্দ হবে। আমার মনে হয়, তাঁরা দু’জনেই এটাই বলবেন যে, ‘‘এই, তোমাকে একদম আমাদের মতো দেখতে। শুধু তোমার গোঁফটা নেই!’’ আবার লালমোহন গাঙ্গুলি তাঁর সবুজ অ্যাম্বাস্যাডর গাড়িতে আমাকে নিয়ে গড়পারে হাওয়া খেতেও যেতে পারেন। একেনবাবু তো একটু কৃপণ। তাই নিজে খরচ করবেন না বলে হয়তো আমার আর জটায়ুর সঙ্গে সেই সফরে জুড়ে বসতে পারেন (হাসি)।
‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ ছবির একটি দৃশ্যে অনির্বাণ চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: পুজো বা বড়দিনে একসঙ্গে ছবির ভিড়ে অনেক সময় ভাল ছবির ক্ষতি হয়। আপনারও অভিনীত একটা ছবির ক্ষেত্রে সম্প্রতি তেমন ঘটেছে। খারাপ লাগে?
অনির্বাণ: এই ক্যালেন্ডার তৈরি করেন প্রযোজক এবং পরিবেশকেরা। সেটা নিয়ে আমার টেকনিক্যাল কোনও জ্ঞান নেই। উৎসবে মানুষ ছবি দেখতে পছন্দ করেন। সেই সুযোগটা সকলেই নিতে চান। এখানে মুখ্য আঞ্চলিক ভাষাকে জায়গা দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম নেই বলে এই বলার জায়গাটা তৈরি হয়। এটা একটা বড় সমস্যা।
প্রশ্ন: কাজের বাইরে আপনাকে সমাজমাধ্যমে পাওয়া যায় না। কাজের বাইরে ইন্ডাস্ট্রির পার্টিতেও থাকেন না। আপনাকে নিয়ে কোনও বিতর্কও নেই।
অনির্বাণ: চারপাশে কী ঘটছে, তা এড়িয়ে যাই না। আমি আমার মতো করে খবর রাখার চেষ্টা করি। গত বছর আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদেও শামিল হয়েছিলাম। তবে সব সময় সব বিষয়ে যে আমাকে মন্তব্য করতেই হবে, সেটা আমি মনে করি না। কিছু জিনিস বুঝি, কিছু জিনিস বুঝি না। সব সময় খবরে থাকতে হবে বলেই মন্তব্য করতে রাজি নই।
প্রশ্ন: ব্যক্তিগত জীবন এখন অনেকেই আড়ালে রাখতে পারেন না। আপনি সেখানে ব্যতিক্রম।
অনির্বাণ: আমি একটু নিজের মতো থাকতে পছন্দ করি। পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবন আলাদা রাখতেই পছন্দ করি। অন্যকেও সেই সম্মানটা দিই। কে কোথায় বেড়াতে গেল, কার ঝগড়া বা বিচ্ছেদ হল— এ সব নিয়ে আমার নিজের কোনও আগ্রহ নেই। বাড়ি থেকে বার হই, শুটিং করি। আবার বাড়িতে ফিরে আসি। আমাকে নিয়েও মনে হয় কারও কোনও আগ্রহ থাকার কথা নয় (হাসি)।
প্রশ্ন: নতুন বছরে আর কী কী কাজ রয়েছে?
অনির্বাণ: ‘অপরিচিত’ মুক্তি পেল। জানুয়ারিতে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ এবং ‘পুরো পুরী একেন’ আসছে। সাত-আটটা ছবি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। দুটো ছবির শুটিং চলছে। এ ছাড়াও নতুন দুটো কাজের কথা চলছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাই না।