গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ
বয়াল। ভোট বাংলার উত্তাপ হঠাৎই বিখ্যাত করে দিল অখ্যাত এই গ্রামটাকে। রাজনীতি টাজনীতি অতটা বোঝেও না বয়াল। বরং, সজনে পাতা ঠিক কেমন দেখতে তার উত্তর সহজেই দিতে পারবে। বলতে পারবে, কেমন হয় কুমড়ো ফুলের রং, কোন মাচায় পটল ফলে। গ্রামের মুদিখানা, মন্দির, মসজিদ সব মিলিয়ে একেবারে পরীক্ষার খাতায় ‘বাংলার গ্রাম’ রচনায় লেখা বর্ণনার মতোই বয়াল। সে গ্রামে গেলে রাজনীতির কচকচির বদলে ‘চই-চই’ করে হাঁসকে পুকুর থেকে বাড়িতে ফেরানোর ডাক শোনা যায়।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ ছবির শ্যুটিং হওয়া বোড়াল গ্রামটার সঙ্গে নামের ধ্বনিগত মিল শুধু নয়, ছবিও ঠিক একই রকম। পিচ রাস্তা থেকে ২ কিলোমিটার ভিতরে ঠিক যেখানটায় বৃহস্পতিবারের ভোটবেলায় গোলমাল হল সেখানে পাড়ার বাইরের কোনও মানুষের পা পড়ে কালেভদ্রে। কিন্তু নীলবাড়ির লড়াই সেই বয়ালকেই শিরোনামে এনে দিল। গত ক’দিন ধরেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভারী বুটের শব্দে নিরাপত্তার আশ্বাস শুনতে পাচ্ছিল বয়াল। কিন্তু বৃহস্পতিবার যা দেখল তা যেন স্বপ্নাতীত।
বৃহস্পতিবার দুপুর সওয়া ১টা পর্যন্ত নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়ায় নিজের অস্থায়ী আস্তানায় ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোজা চলে যান বয়ালে। জানা গিয়েছিল, বয়াল হয়ে সোনাচূড়া, গোকুলনগরেও যাবেন তিনি। কিন্তু মক্তব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েই আটকে যান তিনি। আসলে হুইলচেয়ারে বসে গ্রামের রাস্তায় ঢুকতেই নেত্রীকে কাছে পেয়ে বুথ দখলের নালিশ জানাতে শুরু করেন স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা। অন্য দিকে, সেখানে উপস্থিত বিজেপি কর্মীরাও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে থাকেন। মমতার নিরাপত্তা রক্ষী, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের তৎপরতায় মারাত্মক কিছু না ঘটলেও মুহূর্তে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়।
নেত্রীকে কাছে পেয়ে বুথ দখলের নালিশ জানাতে শুরু করেন স্থানীয়রা। ছবি : পিটিআই
এর পরে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। বুথেই বসে পড়েন মমতা। সেখান থেকে নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের পাশাপাশি রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কেও ফোন করেন মমতা। তিনি জানান, বয়ালে ভোট দিতে দেওয়া হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা তাঁর হাতে নেই। রাজ্যপাল যেন ব্যবস্থা নেন। বাইরে বুথ চত্বরে তখন তুমুল উত্তেজনা। তত ক্ষণে বয়ালে চলে আসেন নির্বাচন কমিশনের ২ পর্যবেক্ষক। তাঁরা মমতার সঙ্গে বুথের উত্তেজনা নিয়ে কথা বলেন। প্রায় দু’ঘণ্টা পর বয়ালের বুথ থাকার পরে মমতাকে কেন্দ্রীয় বাহিনী, রাজ্য পুলিশ এবং কমিশনের আধিকারিকরা কড়া নিরাপত্তায় বার করে আনেন।
এর পরে বয়ালে যান বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। দিনভর ‘ভোট শান্তিপূর্ণ’ দাবি করা শুভেন্দু হাসি মুখে বয়ালেও একই কথা বলেন। নেতাকে কাছে পেয়ে বিজেপি কর্মীদের গলায় আবার ওঠে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। বয়াল শোনে মমতার পাশাপাশি শুভেন্দুও বলছেন, ‘‘আমিই জিতব নন্দীগ্রামে।’’
হিন্দু-মুসলমান মিশ্র বসতির বয়ালের নাম আগেও শোনা গিয়েছে। সেটা ২০২০ সালের নভেম্বরে। তখনও তৃণমূল নেতা শুভেন্দুর গড় হিসেবে পরিচিত নন্দীগ্রাম। গত বছরেরে ২১ নভেম্বর কলকাতার হেস্টিংসে রাজ্য বিজেপি-র প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে গেরুয়াশিবিরে যোগ দেন বয়ালের তৃণমূল নেতা তথা ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পবিত্র কর। সঙ্গে নন্দীগ্রাম ১ ও ২ নম্বর ব্লকের ১৭টি পঞ্চায়েতের বেশ কয়েকজন সদস্য। তারও আগে ২৪ অগস্ট বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন বয়ালের শ’দেড়েক তৃণমূল কর্মী। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিজেপি-র তমলুক সাংগঠনিক জেলার সহ-সভাপতি প্রলয় পাল। ক’দিন আগে ‘সাহায্য’ চেয়ে যাঁকে মমতা ফোন করেছিলেন সেই প্রলয়ের বাড়িও বয়ালেই।
এক দিন জমি আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে অখ্যাত নন্দীগ্রাম জায়গা করে নিয়েছিল রাজনৈতিক মানচিত্রে। এ বার সেই নন্দীগ্রাম বিধানসভা এলাকার তস্য অখ্যাত বয়াল চলে এল আলোচনার আলোয়।