প্রতি-পক্ষ: ভোটের প্রচারে এমন হুড খোলা জিপের চাহিদা তুঙ্গে। তবে চলছে অটোয় চড়ে প্রচারও। ছবি: রণজিৎ নন্দী এবং নিজস্ব চিত্র।
মাথার উপরের প্লাস্টিক প্রায় খুলে গুটিয়ে রাখা হয়েছে। এক জনের দাঁড়ানোর মতো জায়গা বার করতে বাঁকিয়ে ফেলা হয়েছে মাথার উপরের লোহার রডও! এর পরে যাত্রীর আসন থেকে চালকের আসন পর্যন্ত কাঠের একটি পাটাতন পেতে তার উপরে গদি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই গদিতে দাঁড়িয়েই চলছে প্রার্থীর ‘রোড শো’!
ভোট-প্রচারের জন্য রাজ্য জুড়ে জিপের বিপুল চাহিদার মধ্যে একটি অটোকেই হুড খোলা প্রচার-যান বানিয়ে ফেলেছেন মানিকতলা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচী। নিজেই বললেন, ‘‘লোকে আমায় অটো-রূপা বলে। এ গাড়ির জুড়ি মেলা ভার। সরু থেকে তস্য সরু গলিতেও অটো সহজে ঢুকে যায়। যত বারই ভোটে দাঁড়িয়েছি, অটোই আমার ভরসা।’’ সেই সঙ্গে রূপার দাবি, ‘‘বাইরে থেকে আনা জিপ তো দূরের কথা, বিজেপির বদান্যতায় জ্বালানির দাম এখন এত যে, অনেকেই গাড়ি চড়ে প্রচার করার কথা ভাবতেও পারছেন না।’’
যদিও জ্বালানির দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও শহরের প্রার্থীদের বড় অংশই হুড খোলা গাড়িতে করে প্রচারের পথে হাঁটছেন। বালিগঞ্জের তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যেমন বললেন, ‘‘হুড খোলা জিপ ছাড়া প্রচার হয় নাকি! যত দিন ভোটে লড়ছি, ওই গাড়িই ভরসা। আসলে হুড খোলা গাড়ির নিজস্ব একটা আকর্ষণ আছে। মানুষ এমনিই দেখেন।’’ কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী অতীন ঘোষেরও দাবি, ‘‘কত ভাবে তো কত টাকা খরচ হয়। প্রচারে হুড খোলা জিপ একটা রেওয়াজ। সেই রেওয়াজ ছেড়ে প্রার্থীদের বেরোনো মুশকিল।’’
এই রেওয়াজকে হাতিয়ার করেই মাস তিনেক আগে থেকে শহরের গ্যারাজগুলিতে ভিন্ রাজ্যের হুড খোলা গাড়ির আনাগোনা শুরু হয়েছে বলে জানাচ্ছেন গ্যারাজ-মালিকেরা। শহরের রিজিয়োনাল ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (আরটিও) সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে শহরে চলছে ভিন্ রাজ্যের নম্বর প্লেট লাগানো প্রায় সাড়ে তিনশো ‘বহিরাগত’ জিপ। কলকাতা পুলিশের থেকেও পাওয়া যাচ্ছে একই পরিসংখ্যান। মল্লিকবাজারের একটি গ্যারাজের সামনে হোর্ডিংয়ে আবার লেখা, ‘রাজস্থানের গাড়ি, কলকাতার ভোট’! সেই গ্যারাজের মালিক তফিক আহমেদের দাবি, ‘‘এমনিতে কলকাতা ঘোরানোর জন্য এই ধরনের কিছু জিপ রাখি আমরা। সারা বছর ভাড়ায় সেই জিপ নেন ভ্রমণ সংস্থার লোকজন। কিন্তু ভোট এলেই জিপের চাহিদা এত বাড়ে যে, এ বার রাজস্থান থেকে আগাম আটটা জিপ আনিয়ে রেখেছিলাম। সেগুলিই এখন ভাড়া খাটছে। কেউ বলতেই পারেন, চাহিদা থাকলে বহিরাগত জিনিসে সমস্যা কী?’’
নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর কাছে একটি গ্যারাজের মালিক আবার জানালেন, তিনি রাজস্থানের পাশাপাশি বিহার থেকেও মোট ১৬টি জিপ আনিয়েছেন। এর মধ্যে এখন কলকাতায় ভাড়া খাটছে ৯টি। বাকিগুলি জেলায় জেলায় ঘুরছে। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতার মধ্যে জিপের দৈনিক ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। দূরের জেলায় যেতে হলে ভাড়া বাড়ে। চালকের থাকা এবং খাওয়ার খরচ আলাদা।’’
লেক টাউনের একটি ‘কার পার্লার’-এর মালিক সৈকত সিংহের আবার চিন্তা মহারাষ্ট্রের একটি সংস্থা থেকে ভোটে ভাড়া খাটানোর জন্য আনা চারটি জিপ নিয়ে। বললেন, ‘‘মহারাষ্ট্রের নম্বর থাকায় ওগুলোর ভাড়াই হচ্ছিল না। এখন বাইরের জিপ বলে বসে থাকলে অকারণ ভাড়া গুনতে হবে।’’
রাজারহাট-গোপালপুরের বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘সবেতেই বহিরাগত খোঁজা একটা রোগ হয়ে গিয়েছে। এই টাকা আর উন্নয়ন আটকে থাকার ব্যথা বুঝেই তো মানুষ এ বার বিজেপি-কে ভোট দেবেন। আমি অবশ্য গাড়ি ছেড়ে হেঁটেই প্রচার চালাচ্ছি।’’ ভবানীপুরের বিজেপি প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষের দাবি, ‘‘এ সব বিতর্কের চেয়েও বড় কথা, কাছে গেলে লোকে ইশারা করে গলা নামিয়ে বলছেন, ভোট ঠিক জায়গাতেই পড়বে। নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যান। গাড়ির রোড শো-এ দূর থেকে হাত নেড়ে কি এই নিশ্চয়তা পাওয়া যেত? তাই আমি গাড়ি ছেড়ে হেঁটেই ঘুরছি।’’