প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি পিটিআই।
নীলবাড়ির লড়াইয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ আগেই স্পষ্ট হয়েছে। এ বার যেন ‘তফসিলি’ ভোটব্যাঙ্ক দখলের লড়াইও শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, নতুন এই অস্ত্রে ধার দেওয়া শুরু করে দিয়েছে গেরুয়াশিবির। মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক যাতে পদ্মের দিকে যায় তার উদ্যোগ অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। অমিত শাহ নিজে গিয়ে ঠাকুরনগরে সভা করেছেন। একই ভাবে রাজবংশী ভোট পদ্মমুখী করতে কোচবিহারে সভা করেছেন শাহ, মোদী দু’জনেই। তবে এখন আর শুধু মতুয়া, রাজবংশী নয়, অন্য তফসিলি সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও স্পষ্ট। চতুর্থ দফার ভোটগ্রহণের দিন গত শনিবার মোদী প্রথম বার এ বিষয়ে তৃণমূলকে আক্রমণ করতে শুরু করেন। সে দিন ২টি সভা এবং সোমবার রাজ্যে ৩টি সমাবেশে মোদী তফিসিলিদের সম্পর্কে ‘তৃণমূলের ধারণা ঠিক নয়’ বলে অভিযোগ তুলেছেন।
শনিবার মোদী তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রথম বার তফসিলিদের ‘ঘৃণা’ করার অভিযোগ তোলেন। বলেন, ‘‘দিদির তৃণমূলের ভাবনা কেমন, সেটা প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। একটা ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সেটা দেখে লোকে চমকে যাচ্ছে। সেই ভিডিয়োয় দিদির ঘনিষ্ঠ এক নেতা তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষদের অপমান করেছেন।’’ সে প্রসঙ্গ টেনে মোদী প্রশ্ন তোলেন, ‘‘দিদি, এত অহঙ্কার? এমন ভাবনা আপনার?’’
আর রবিবার তিনি বলেন, ‘‘আপনারাই বলুন, দিদির পার্টির নেতা যে ভাবে দলিত, তফসিলিদের গাল দিচ্ছেন, তা নিয়ে উনি কি কাউকে কিছু বলেছেন? নিজেকে তো দিদি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বলেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া তৃণমূলে কি কেউ কিছু বলতে পারে? তা হলে তাঁর দলের লোকেরা যখন তফসিলিদের ভিখারি বলছেন এবং তার পরেও দিদির যখন কোনও অনুশোচনা নেই, ক্ষমাও চাননি, তা হলে এটাই বুঝতে হবে যে দিদির নির্দেশেই এ কথা বলেছেন।’’ মোদী রাজ্যে এসে এমন দাবিও করেছেন যে, বিজেপি-র প্রতি তফসিলিদের ভালবাসাই ঘৃণার কারণ। মোদী বলেন, ‘‘দিদি আর তার লোকেরা তফসিলিদের ভয় পায় কারণ, ওই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিজেপি-কে সমর্থন করে।’’
গ্রাফিক:- শৌভিক দেবনাথ।
কিন্তু কেন এমন দাবি করছেন মোদী? রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, এই দাবির পিছনে রয়েছে বড় অঙ্ক। একটা সময়ে বামেদের দখলে থাকা তফসিলি ভোট ২০১১ সালেই তৃণমূলের পক্ষে চলে আসে। সেই সমর্থন ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও জোড়াফুলের সঙ্গেই ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন তার অনেকটাই বিজেপি-র দিকে চলে আসে। রাজ্যে ১৮টি লোকসভা আসনে জয়ের পিছনে তফসিলিদের যথেষ্টই আশীর্বাদ পেয়েছিল বিজেপি।
রাজ্যে তফসিলি জাতি (এসসি) আসন রয়েছে ৬৮টি আর তফসিলি জনজাতি (এসটি) আসন রয়েছে ১৬টি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৬৮টি তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত আসনের ৪৯টি পেয়েছিল তৃণমূল। ভোট প্রাপ্তি ছিল ৪৬.৪১ শতাংশ। বাম কংগ্রেস জোট ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯টি আসনে জেতে। আর বিজেপি-র ভাঁড়ার ছিল শূন্য। ভোট প্রাপ্তি ছিল ৯.৯৩ শতাংশ। একই ভাবে তফসিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনেও দাপট ছিল তৃণমূলের। মোট ১৬টি আসনের মধ্যে ১৩টি পায় জোড়াফুল শিবির। বাম-কংগ্রেস জোট পায় ২টি এবং বিজেপি ১টি।
২০১৯ সালে গোটা ছবিটাই বদলে যায়। লোকসভা ভোটের নিরিখে বিধানসভা অনুযায়ী ফলের হিসেব বলছে ৬৮টি তফসিলি আসনের মধ্যে তৃণমূল ও বিজেপি পায় যথাক্রমে ৩৪ ও ৩৩টি। আর কংগ্রেস ১টি। ১৬টি জনজাতি আসনের ক্ষেত্রে আবার তৃণমূলের তুলনায় বিজেপি অনেকটাই এগিয়ে। ১৩টিতে জয় পায় বিজেপি আর তৃণমূল ৩টিতে।
রাজ্যে হওয়া সর্বশেষ নির্বাচনের ধারা অনুযায়ী তফিসিলি আসনগুলিতে বিজেপি ‘সুবিধাজনক’ জায়গায়। এখন সেই ভোট নিশ্চিত করার পাশাপাশি তফসিলিদের মধ্যে আরও আধিপত্য বিস্তারই বিজেপি-র লক্ষ্য। কারণ, রাজ্যের এই ৮৪টি আসন শুধু ক্ষমতার সমীকরণই নয় গড়ে দিতে পারে বড় ব্যবধান। তাই তৃণমূলও বসে নেই। লোকসভা নির্বাচনে তফসিলি সমর্থন কমে যাওয়ার পরে বিভিন্ন তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য আলাদা বোর্ড গঠন করেছে তৃণমূল সরকার। লোকসভা নির্বাচনে সমর্থন কমলেও এ বার সেটা তৃণমূলের দিকে ফিরবে বলে আশাবাদী দলের নেতারা।