—ফাইল চিত্র।
তিয়াত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সেও ক্লান্তিহীন। ছুটছেন রানাঘাট উত্তর পশ্চিম কেন্দ্রের প্রার্থী শঙ্কর সিংহ।
এক সময়ে রানাঘাট আর শঙ্কর সিংহ প্রায় সমার্থক হলেও এখন যেন সেই দাপট ফিকে হতে শুরু করেছে। তবু এমন সময়ে প্রায় হারা ম্যাচ জেতানোর দায়িত্বও তাঁরই কাঁধে। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও সাহস এবং অভিজ্ঞতাই এই যুদ্ধ জয়ে তাঁর এবং দলের বড় ভরসা। ফলে, নিজে জেতা ছাড়াও অন্যান্য কেন্দ্রেও মেরুকরণের হাওয়া ঠেকাতে ছুটতে হচ্ছে তাঁকে।
নদিয়া দক্ষিণের আটটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ২০১৬ সালের নির্বাচনে শাসক দল তৃণমূল জিতেছিল পাঁচটি কেন্দ্রে। বাম কংগ্রেস জোট জিতেছিল তিনটি। অথচ মেরুকরণের ঝড়ে ২০১৯ সালের হিসেবে সব ক’টি কেন্দ্রেই এগিয়ে পদ্ম শিবির। ফলে রানাঘাট উত্তর –পশ্চিম এবং শান্তিপুরের মতো কেন্দ্রেও এ বার জোরদার লড়াইয়ের সম্ভাবনা।
রানাঘাট উত্তর পশ্চিমে লোকসভার নিরিখে প্রায় ৪৪ হাজার ভোটে পিছিয়ে তৃণমূল প্রার্থী শঙ্কর সিংহ। বাম কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়ে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন শঙ্কর বাবু। পরে, কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় তাঁর গায়েও ‘বিশ্বাসঘাতকে’র তকমা লাগে। বয়স এবং নানাবিধ অসুস্থতার কারণে লকডাউনের সময় তাঁকে পাশে না পাওয়ার অভিযোগ করছেন রানাঘাটের একাংশের মানুষ। তবে, ঘনিষ্ঠদের দাবি, ঘরবন্দি হয়ে থাকলেও ত্রাণের কাজ তদারকি করেছেন তিনি।
আদপে চাকদহের বাসিন্দা হলেও শঙ্করবাবুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুরোটাই রানাঘাটকে কেন্দ্র করে। নিজের সেই সব পুরনো যোগাযোগের উপরেই ভরসা রাখছেন তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘লোকসভা নির্বাচনে মেরুকরণের প্রবল হাওয়া এখন আর নেই। বিজেপির প্রতিশ্রুতি যে ফাঁকা আওয়াজ, মানুষ তা বুঝতে পারছেন। নাগরিকত্ব দেওয়ার যে কথা বিজেপি বলছে, অসমের অভিজ্ঞতায় মানুষ তা বিচার করবেন।’’
ওই কেন্দ্রে শঙ্কর সিংহের প্রধান প্রতিপক্ষ পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন মাস কয়েক আগে। ওই দলবদলে বিজেপি'র স্থানীয় কর্মকর্তাদের একাংশ ক্ষুণ্ণ হয়ে ইস্তফা দিতে তৎপর হন বলেও খবর। নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। ফলে, তার প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে বিজেপি'র অন্দরেই।
এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার বিজয়েন্দু বিশ্বাস কংগ্রেসের পুরনো কর্মী। দুই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধ দল পাল্টানোর অভিযোগ নিয়ে ভোটের আসরে নেমেছেন তিনি। বামেদের ভোটের একাংশ পেতেও পারেন। তাতে অবশ্য তৃণমূল প্রার্থীর সুবিধে হওয়ার সম্ভাবনা।
একই রকম কঠিন লড়াই শান্তিপুরেও। ওই কেন্দ্র থেকে টানা ৬ বার জেতা বিধায়ক অজয় দে লোকসভা নির্বাচনের হিসেবে বিজেপির চেয়ে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার ভোটে পিছিয়ে। তবু, শান্তিপুরকে অজয় দে চেনেন প্রায় হাতের তালুর মতোই। সেই অভিজ্ঞতায় ভর করে নিজস্ব সংগঠন দিয়ে ভোট পেরোতে চাইছেন তিনি। পাশাপাশি ওই কেন্দ্রের প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যলঘু ভোটের বড় অংশ তৃণমূল পাবে বলেও তাঁর আশা। ওই কেন্দ্র থেকে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেসের-তৃণমূল জোটের প্রার্থী অরিন্দম ভট্টাচার্য। পরে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। স্থানীয় মানুযের ক্ষোভ আঁচ করেই অরিন্দমের বদলে রানাঘাটের দলীয় সাংসদ জগন্নাথ সরকারকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। যথেষ্ট সংগঠন না থাকার কথা মানছেন তিনি। জনসংঘও তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে। তবু মেরুকরণ এবং পরিবর্তনের হাওয়ায় জয় পাওয়া নিয়ে নিশ্চিত জগন্নাথ।
এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী ঋজু ঘোষাল প্রচারে সাড়াও পাচ্ছেন। তবে, কংগ্রেসকে লড়তে হচ্ছে প্রার্থীদের দলবদলের ইতিহাসের সঙ্গে। এ বারের প্রার্থী যে কোনও ভাবেই কংগ্রেস ছেড়ে যাবেন না, প্রচারে সে কথা বার বার বলতে শোনা গিয়েছে প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীকে। ঋজু বলছেন, ‘‘শান্তিপুর কংগ্রেসের ঘাঁটি। এখানে যে সব প্রার্থী তাঁদের বিশ্বাস নষ্ট করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন ভোটারেরা। ’’
আগামী ১৭ এপ্রিল নদিয়া দক্ষিণের যে আটটি বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচন রয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি কেন্দ্র সংরক্ষিত। ওই সব কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে, রানাঘাট উত্তর পূর্ব, রানাঘাট দক্ষিণ , কৃষ্ণগঞ্জ, কল্যাণী এবং হরিণঘাটা। এই পাঁচটি কেন্দ্রে তফশিলি এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটারদের প্রাধান্য রয়েছে। ফলে, ওই সব কেন্দ্রে মেরুকরণ এবং নাগরিকত্ব নির্বাচনের অন্যতম প্রধান বিষয়। কল্যাণী এবং হরিণঘাটায় লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির তুলনায় কয়েক হাজার ভোটে পিছিয়ে রাজ্যের শাসক দল। কিন্ত, রানাঘাট উত্তর পূর্ব এবং রানাঘাট দক্ষিণ এবং কৃষ্ণগঞ্জে ওই ব্যবধান অনেক বেশি।
কল্যাণী এবং হরিণঘাটায় তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দিতে কোমর বেঁধে নেমেছে সংযুক্ত মোর্চাও। কল্যাণীতে তৃণমূলের প্রাথী বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ বিশ্বাস। সংগঠন ছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের কাছে তথ্যপ্রযুক্তির অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত বাড়তি সুবিধা দেবে বলে আশা করছেন তিনি। বাম প্রার্থী সবুজ দাস কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া এবং জেলার ছাত্র আন্দোলনের নেতা। দুর্নীতি এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে মানুষ বামপন্থীদের বেছে নেবেন বলে তাঁর আশা।
হরিণঘাটায় সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী প্রাক্তন সাংসদ সিপিএম নেতা অলকেশ দাস। সংখ্যালঘু এবং তফশিলি জাতির একাংশের সমর্থন তাঁদের দিকে আসবে বলে দাবি বাম প্রার্থীর। আইএসএফের সংগঠন রয়েছে ওই কেন্দ্রে। শাসক দলের প্রাথী নীলিমা নাগ মল্লিক মূলত উন্নয়নের উপর নির্ভর করেই ভোট চাইছেন। প্রায় ৩৬ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের দাবিদারও তিনিও। কল্যাণী এবং হরিণঘাটা— দুই কেন্দ্রেই সংগঠন দুর্বল হলেও মেরুকরণ এবং পরিবর্তনের হাওয়াতেই আস্থা রাখছে গেরুয়া শিবির।
রানাঘাট দক্ষিণ কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী বর্ণালী দে বিশ্বাস। লকডাউনের সময় পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ওই এলাকায় টানা ত্রাণের কাজ তাঁকে পরিচিতি দিয়েছে। কঠিন কেন্দ্রে তাঁকেই প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে দিয়েছে দল। ওই কেন্দ্রে বিজেপি'র প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারী এবং সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সিপিএমের রমা বিশ্বাস। লোকসভায় নিরিখে বিজেপির প্রাধান্য থাকলেও মেরুকরণের হাওয়া কাটিয়ে লড়াই দেওয়ার প্রশ্নে আশাবাদী বর্ণালী।
রানাঘাট উত্তর-পূর্বে প্রায় ৪৩ হাজার এবং কৃষ্ণগঞ্জে প্রায় ৩৭ হাজার ভোটে বিজেপি'র তুলনায় পিছিয়ে তৃণমূল। ওই দুই সংরক্ষিত আসনে মতুয়া ভোটের কতটা ফেরত আনা যাবে, তার উপরেই নির্ভর করছে তৃণমূলের হারজিৎ।
এ বার চাকদহ কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী শুভঙ্কর সিংহ ( জিশু)। শঙ্কর সিংহের পুত্র তিনি। বিপরীতে বি জে পি প্রার্থী বঙ্কিম ঘোষ এবং সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সিপিএমের নারায়ণ চন্দ্র দাশগুপ্ত। এক সময় বাম সরকারের মন্ত্রী বঙ্কিম সিপিএম থেকে বিজেপিতে গিয়েছেন। তবে, এখনও ওই বিধানসভায় পোক্ত সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি বিজেপি। ভোটের অঙ্কে লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও উন্নয়নের নিরিখেই ভোট হবে বলে আশাবাদী তিনি।
তবে শেষ পর্যন্ত জিতবে কে? মেরুকরণ নাকি উন্নয়ন?