চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, তন্ময় ভট্টাচার্য, অর্চনা মজুমদার ফাইল চিত্র।
একটা ছোট ট্রাকে অন্তত পাঁচটা বক্স। তাতে টানা বেজে চলেছে ‘খেলা হবে’। আওয়াজে কান পাতা দায়। এর পরে রণপা, ঢাকির দল, সাদা, সবুজ, গেরুয়া রঙের বেলুন-সহ মিছিল। নিমতার আলিপুর অঞ্চলের সেই মিছিলে একটু পরেই যোগ দিলেন উত্তর দমদম বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। মিছিল চলল এলাকা পরিক্রমায়। চন্দ্রিমা জানিয়ে দিলেন, এ বার উত্তর দমদম তৃণমূলেরই। দ্বিতীয়, তৃতীয় কে হবে— সে নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই।
গত বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে হেরেছিলেন চন্দ্রিমা। তাঁকে হারিয়ে বিধানসভায় গিয়েছিলেন সিপিএমের তন্ময় ভট্টাচার্য। পরে কাঁথি দক্ষিণ কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জিতে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন চন্দ্রিমা। আরও বেশ ক’টি দফতরের দায়িত্বেও তিনি। চন্দ্রিমার দাবি, হেরে গেলেও এত ব্যস্ততার মধ্যে তিনি উত্তর দমদমকে ভোলেননি। যতটা সময় তিনি কাঁথি দক্ষিণকে দিয়েছেন, ততটাই দিয়েছেন উত্তর দমদমকে। বললেন, ‘‘এই কেন্দ্রের মানুষ গত পাঁচ বছরে সুখে-দুঃখে আমাকে পেয়েছেন। আমপান, করোনার সময়ে এলাকায় ঘুরেছি। সকলের সঙ্গে থেকেছি।’’ তাই জয় নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী তিনি।
গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিলেন ১৫ হাজারের সামান্য কিছু বেশি ভোট। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮ হাজারেরও বেশি। তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায় বিজেপি প্রার্থীর থেকে এই কেন্দ্রে এগিয়ে ছিলেন মাত্র ৫,৬৪৯ ভোটে। বিজেপি অবশ্য এ বার এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে এলাকায় সম্পূর্ণ অপরিচিত অর্চনা মজুমদারকে। মুকুল রায় তৃণমূলে থাকার সময়ে তাঁর কাছের লোক বলেই রাজনৈতিক মহলে পরিচিত ছিলেন অর্চনা। তাঁর বিজেপির টিকিট প্রাপ্তি মুকুলবাবুর জন্য বলেই রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য। পেশায় ডাক্তার অর্চনাও জানালেন, তিনি অরাজনৈতিক মানুষ। তাঁর পরিবারের প্রায় সকলেই ডাক্তার। বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূ, জামাই, ভাই, বোন— সকলে। এই কেন্দ্রের প্রার্থী হয়ে ঘরে ঘরে যাচ্ছেন অর্চনা। এলাকার মানুষের দুর্দশার কথা শুনে তাঁর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বললেন, ‘‘বেকারত্ব, মহিলাদের অপমান, সিন্ডিকেট-চক্র, কাটমানি খাওয়া— কী নেই এই কেন্দ্রে!’’ জানালেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যেই তিনি এই কেন্দ্র থেকে জিতবেন।
অর্চনার অভিযোগ, ‘‘আমি উন্নয়নের কথা বলে ভোটে প্রচার চালাচ্ছি। কিন্তু তন্ময়বাবু হিন্দু-মুসলমানের খেলা খেলছেন।’’ তাঁর ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি। বললেন, ‘‘বাঁকড়া, বিশরপাড়া-সহ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে আইএসএফ নেতা আব্বাস সিদ্দিকীকে এনে মিটিং করেছেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী তন্ময়বাবু।’’ অর্চনার আরও দাবি, ওই এলাকাগুলিতে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদের ঢোকানো হয়েছে।
এই বিষয়ে তন্ময়ের জবাব, এ সব সত্যি কি না, নির্বাচন কমিশন তদন্ত করুক। তিনি বলেন, ‘‘আমি এখনও ওই অঞ্চলগুলিতে কোনও সভা করে উঠতে পারিনি। শুধু প্রার্থী-পরিচিতির জন্য ঘরে ঘরে গিয়েছি। এ সব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।’’ গত বার তন্ময়ের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন চন্দ্রিমা। তিনি দাবি করছেন, এ বার জিতছেন। কারণ, গত পাঁচ বছরে এলাকার মানুষের সঙ্গে তিনি ছিলেন। এই প্রসঙ্গে তন্ময়ের উত্তর, ‘‘হ্যাঁ, এই এলাকায় উনি আসতেন। তবে উত্তর দমদমের তৃণমূল সভাপতি, যিনি নিজের শরীরের ওজনের থেকে বেশি ওজনের সোনা শরীরে বহন করেন, শুধু তাঁর বাড়িতে। এলাকার মানুষ তাঁকে দেখেননি।’’ যদিও চন্দ্রিমার দাবি, এই কেন্দ্রে করোনা, আমপানের সময়ে কাজ করলে তৃণমূলই করেছে। সব জায়গা জীবাণুমুক্ত করার দায়িত্বও নিয়েছিল তারা। তন্ময়কে কেউ দেখেননি। চন্দ্রিমা বলেন, ‘‘তন্ময়বাবুকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। তাই মানুষ ধরেছে। এ নিয়ে তো ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছিল। দমদম উত্তরের তৃণমূল সভাপতি বিধান বিশ্বাসের উপরে কেন তন্ময়বাবুর এত রাগ, জানি না। এ সব ব্যক্তিগত আক্রমণ।’’ তন্ময় অবশ্য জানালেন, গত পাঁচ বছর সপ্তাহে পাঁচ দিন দু’ঘণ্টার জন্য এলাকায় বসেছেন। প্রত্যেকের অভাব-অভিযোগ শুনেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘এক জনও এসে বলতে পারবেন না যে, আমি তাঁর কথা শুনিনি।’’
সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী বলছেন, করোনাকালে ১০০ দিন টানা কমিউনিটি কিচেন চালানো, পাঁচ টাকার জনতার বাজার চালানো হয়েছে। পাঁচ বছরের কাজের হিসেব দিয়ে লিফলেটও তৈরি তন্ময়ের। তাঁর অভিযোগ, তৃণমূল পরিচালিত উত্তর দমদম, নিউ ব্যারাকপুর পুরসভাকে তাঁর বিধায়ক তহবিল থেকে যে টাকা তিনি দিয়েছিলেন, সেটা তারা খরচ করেনি। কিছু স্কুলকেও বিধায়ক অর্থ দিলে তা খরচ করতে বারণ করা হয়েছে। চন্দ্রিমা অবশ্য বলেন, ‘‘উনি দুই পুরসভাকে টাকা দিতে পারেননি। পুরসভা টাকা নেয়নি আবার কী? আর আমরা কি স্কুলে স্কুলে গিয়ে ওঁর টাকা নিতে বারণ বলেছি? সব ভিত্তিহীন অভিযোগ।’’
নির্বাচনের দিন অশান্তির আশঙ্কাও করছেন তন্ময়। বললেন, ‘‘আমার কেন্দ্রের নির্বাচনের আগে আশপাশের সব কেন্দ্রে নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। একটা দ্বীপের মতো রয়ে গিয়েছে উত্তর দমদম। আশঙ্কা করছি,কেন্দ্রের যে কোনও প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অশান্তি বাধানো হতে পারে। বিষয়টি আমি ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে জানিয়েছি। জানিয়েছি জেলা প্রশাসনকেও।’’ তন্ময়ের বিশ্বাস, নির্বিঘ্নে ভোট হলে এ বারও এই কেন্দ্র সিপিএমেরই থাকবে। তবে চন্দ্রিমার বক্তব্য, ‘‘এ সব অমূলক কথাবার্তা। আগে গত লোকসভা নির্বাচনে ওঁদের যে ভোট রামে গিয়েছে, তা বামে ফেরাতে পারেন কি না, সে নিয়ে ভাবুন তন্ময়বাবু।’’