শূন্য এ বুকে: এবারের ভোটে অদ্ভুত এক শূন্যতা। ২০১১ সাল থেকে পরপর চারবার যাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে প্রতিটি পদক্ষেপ করতেন, সেই স্ত্রী প্রয়াত। ২০১৭ সালে পার্থকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন স্ত্রী বাবলি। চার বছর পর আবার ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ তিনি। বাবলি নেই। বার বার স্মৃতিতে আসছে তাঁর কথা। মানছেন, প্রচারের বেরোনোর আগে বা প্রচার থেকে ফিরে স্বস্তির দু’কথা বলার লোকটা আর নেই। আমেরিকাপ্রবাসী কন্যা প্রতিদিন খোঁজ নিয়ে শূন্যস্থান ভরাটের চেষ্টা করছেন। প্রচারে সঙ্গ দিচ্ছেন ভাই সুদীপ্ত ও জামাতা কল্যাণময় ভট্টাচার্য। কিন্তু কোথাও একটা খাঁ-খাঁ করা অনুভূতি।
চাটুজ্যে বনাম চাটুজ্যে: বেহালা পশ্চিমের টানা চারবারের বিধায়ক। এবার লড়াই পঞ্চমবার জয়ের জন্য। গত চারবারের মধ্যে তিনবার লড়াই চট্টোপাধ্যায়দের বিরুদ্ধেই। ২০০৬ সালে সিপিএমের নিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। ২০১৬ সালে সিপিএমের কৌস্তুভ চট্টোপাধ্যায়। আর এই ২০২১ সালে বিজেপি-র অভিনেত্রী-প্রার্থী শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়। এই খতেন অঞ্জন দত্ত জানলে নির্ঘাত সিনেমা বানাতেন— ‘চাটুজ্যে বনাম চাটুজ্যে’। অথবা ‘চাটুজ্যে কানেকশন’।
মামার বাড়ির আব্দার: পার্থর প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি-র শ্রাবন্তী নিজেকে ‘বেহালার ভূমিকন্যা’ বলে দাবি করে প্রচার শুরু করেছেন। সিপিএম প্রার্থী নীহার ভক্তেরও দাবি একই! বেহালা পশ্চিমের চারবারের বিধায়ক আদতে নাকতলার বাসিন্দা। কিন্তু বেহালা পশ্চিমের ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বিশালাক্ষীতলায় তাঁর মামাবাড়ি। যে কেউ এসে নিজেকে ‘ভূমিকন্যা’ বা ‘ভূমিপুত্র’ বলে দাবি করে ভোট চাইবেন— এ কি মামার বাড়ির আব্দার!
ভূমি (কন্যা বনাম কর্ম): পার্থের বেহালা-যোগের শিকড় আরও গভীরে। বেহালার ১৪ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের বিপরীতে আর্য সমিতির গলিতে ছিল তাঁর মাসির বাড়ি। ছাত্র-রাজনীতির শুরুতে বেহালা কলেজে ছাত্রনেতা হিসেবে ভাষণ দিতে, কাজ করতে এসেছেন একাধিকবার। আর ১৯৮৬ সাল থেকে কর্মজীবনের পটভূমিকাতেও বেহালার সুর। বেসরকারি সংস্থায় জেনারেল ম্যানেজার থাকাকালীন কর্মস্থল ছিল বেহালাই। তাই ভূমিকন্যার পাল্টা বেহালাকে নিজের কর্মভুমি হিসেবে তুলে ধরছেন পার্থ।
বিজয়কেতন: নাকতলার বাড়ির নাম। একবার ছাড়া সবসময়েই এই বাড়িতে বিজয়কেতন উড়েছে। ২০০৫ সালে কলকাতা পুরসভার ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে তৎকালীন বামফ্রন্টের মেয়র পদপ্রার্থী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। সেটা ছিল পুরভোট। কিন্তু বিধানসভার ভোটযুদ্ধে এখনও অপরাজেয়। যদিও সেই বিজয়কে মাথায় রেখে বাড়ির নাম নয়। পার্থের স্বর্গীয় পিতার নাম বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। নাকতলায় নিজের উপার্জনে তৈরি করেছেন ভদ্রাসন। প্রয়াত পিতার নামে বাড়ির নাম রেখেছেন সুপুত্র।
মায়ের বকুনি: বয়স ৭৮। দেখে যদিও বোঝা যায় না। বাড়িতে অভিভাবক নবতিপর মাতা শিবানী চট্টোপাধ্যায়। যিনি এখনও নিয়মিত সকালে খবরের কাগজ দেখেন। ছেলে কারও সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য বা সমালোচনা করেছেন দেখলেই বকুনি দেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে। এখনও ছেলেবেলার মতোই মাথা নীচু করে নীরবে মায়ের শাসন শোনেন। শিবানী বলেন, ‘‘কুমন্তব্য থেকে বিরত থাক!’’ মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। মায়ের কাছেই নেন নীতিপরায়ণতার পাঠ। মা’কে প্রণাম করেই রোজ বাড়ি থেকে বেরোন। ছুঁয়ে যান প্রয়াত পিতার ছবিও।
কাতুকুতু: ওজনদার নেতা। ফ্রেঞ্চকাটের ফাঁকে কখনও সখনও ফিচেল হাসি ঝোলে বটে। কিন্তু সাংবাদিক বৈঠকে ভারী ভারী তৎসম শব্দও বিনা আয়াসে ব্যবহার করেন। ডাকনামটি কিন্তু পুরোপুরি বিপরীত। হাল্কা এবং মিষ্টি— কাতু। শুনলে একটু কাতুকুতু লাগে। হাসিও পায়। তবে এখন ‘কাতু’ বলে ডাকার লোক কমে যাচ্ছে। শুধু মা-ই ওই নামে ডাকেন। খুব ঘনিষ্ঠরা ছাড়া এই নাম কেউ খুব একটা জানেন না। অনুগামীরা বিস্মিত হন— এই নামও আছে নাকি!
রসিকজন: তিনি সেই সুলভ রাজনীতিক, যাঁর সামান্য সমালোচনাতেই রক্তক্ষরণ হয়। সে নিজের হোক বা দলের। আবার তিনিই সেই বিরল রাজনীতিক, যিনি নিজের কার্টুন দেখলে খুশি হন। এমনকি, কার্টুন পছন্দ হলে চেয়ে নিয়ে ফ্রেমে বাঁধিয়ে বাড়িতে টাঙিয়েও রাখেন।
কুছ কুছ হোতা হ্যায়: রাজনৈতিক জীবনে সবই অপ্রত্যাশিত। ২০০১ সালে প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল বালিগঞ্জে। প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় পিছিয়ে যাওয়ায় শেষে বেহালা পশ্চিমে প্রার্থী হন। জেতেন। ২০০৬ সালে বিধানসভায় তৃণমূলের মাত্র ৩০ জন বিধায়ক। হবি তো ’হ, সেবারই রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে বসলেন বিরোধী দলনেতা পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের অনেক সিনিয়র বিধায়ককে টপকে পার্থ বিরোধী দলনেতা। ২০১১ সালে ‘পরিবর্তন’-এর পর শিল্পমন্ত্রী। কিন্তু ২০১২ সালে শিল্প দফতর হাতছাড়া। আবার ২০১৩ সালে শিক্ষামন্ত্রী। খানিকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই। তবে ‘যাবতীয় কৃতিত্ব’ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই।
জিপসি: টানা ২০ বছর এলাকার বিধায়ক। তাও বেহালা পশ্চিমের প্রতিটি অঞ্চলে একবার করে হলেও ভোটের আগে পৌঁছতে চান তিনি। ২০১৬ সালের ভোটে একটি জিপে বসে নিজের প্রচারসূচি সাজিয়েছিলেন পার্থ। এবং ধরে ধরে সেসব এলাকায় গিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পরের ভোটযুদ্ধে ফিরে এসেছে সেই জিপ। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত প্রচার। আবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা। মুখ্য নির্বাচনী এজেন্ট অঞ্জন দাসকে প্রচারসূচি সাজাতে হচ্ছে পার্থের সময় ও এলাকা পরিচিতি মাথায় রেখেই। সেসব এলাকাতেই গড়িয়ে যাচ্ছে জিপের চাকা।
সেঞ্চুরিয়ন: রাজনৈতিক ওজন তো বহুদিনই ছিল। দেহের ওজনও ১০০ কিলো ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নীচু হয়ে পায়ের স্নিকার্স জোড়ার ফিতে বাঁধতেও কষ্ট হত। দলনেত্রী মমতা তো আদর করে ‘মোটাবাবু’ বা ‘মোটু’ বলে ডাকতেও শুরু করেছিলেন। সম্ভবত, এ ধরাধামে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, সেঞ্চুরি থেকে যাঁর রান কমল। ক্রমবর্ধমান কলেবরের কথা ভেবে খাদ্যতালিকায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ এনেছেন। ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ওজন কমে এসেছে ১০০ কিলোর নীচে। এখন শুধু রুটি-সব্জি। মূলত তরিতরকারি আর ফলমূলের উপরেই থাকেন। সঙ্গে বিবিধ স্যুপ। ভোটের জন্য সকলেই একটু হাল্কা খাবার খান। পার্থের খাদ্যতালিকায় বিশেষ রদবদল করতে হয়নি।
আসল প্রতিমা: অক্টোবরের ৬ তারিখে জন্মদিন। প্রায় বছরেই পুজোর সময় পড়ে। এমনিতে পার্থের ক্লাব নাকতলা উদয়ন সংঘের পুজো বেশ ধুমধাম করে হয়। প্রাইজ-টাইজও পায়। কিন্তু আসল প্রতিমা তো পার্থ নিজে! ক্লাবের উদ্যোগে প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালিত হয়। ছবি দেওয়া হয় নেটমাধ্যমে। ছবি ভাইরাল হয়। ট্রোল্ডও হন তিনি। তবে প্রতিমা তো। কুছ তো লোগ কহেঙ্গে। ওসবের পরোয়া করেন না।
তথ্য: অমিত রায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী