ম্যাডাম চিফ মিনিস্টার: নবান্নের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন। তাঁকে প্রশাসনিক আধিকারিক ছাড়া কেউই ‘ম্যাডাম’ বলেন না। ফিরহাদ ‘দিদি’ বলেন গোটা বাংলার মতো। এই ‘ম্যাডাম’ অন্য ম্যাডাম। ওয়েব সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র। দিনভর কাজের পর রাতে বাড়ি ফিরে দেখেন হিন্দি সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ। এখনও পর্যন্ত পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে রিচা চড্ডা অভিনীত ‘ম্যাডাম চিফ মিনিস্টার’। দু’নম্বরে পঙ্কজ ত্রিপাঠি অভিনীত ‘মির্জাপুর’।
ম্যাডাম হোম মিনিস্টার: তিনি একজন শান্তশিষ্ট পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক। চেতলার বাড়িকে কড়া অনুশাসনে বেধেঁ রেখেছেন স্ত্রী রুবি। কোভিড-কালে বাড়িতে ঢুকে বাইরের পোশাক ছেড়ে স্নান করেই অন্যকিছু করার অনুমতি দেন। স্নেহের নাতনি আয়াতকে ছোঁয়ার ক্ষেত্রেও বহুবিধ নিষেধাজ্ঞা। তবে ফিরহাদ কোনও বিবাদে না গিয়ে অক্ষরে অক্ষরে অনুশাসন মেনে চলেন। স্মিত হেসে বলেন, ‘‘ওর কঠিন অনুশাসন আছে বলেই আমার পরিবার, বাড়ি আর আমি ভাল আছি।’’
স্যর চেতলা মিনিস্টার: চেতলা তাঁর বাল্য, কৈশোর, তারুণ্য আর যৌবনের ভূমি। রাজনীতির জীবন শুরু করার আগে ক্লাব-সংস্কৃতি করার সুবাদে পাড়ার গুরুজনদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তার পর সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কাউন্সিলর-বিধায়ক-মন্ত্রী-মেয়র হয়েছেন। কিন্তু এখনও তিনি পরিচিত ‘চেতলার ছেলে’ বলেই। সময় পেলেই আড্ডা মারেন পাড়ায়। কারও সমস্যা হলে তিনিই মুশকিল আসান। একবার এলাকার এক সিপিএম বাড়ির ছেলের বিয়ের পাত্রী ঠিক করতেও ডাক পড়েছিল। আরেকবার ডাক পড়েছিল তিনতলার কার্নিশে আটক বেড়ালকে নামিয়ে আনতে। তখন তিনি রাজ্যের মন্ত্রী। কিন্তু তাতে কী! তাঁর আসল দফতর তো চেতলা।
ডিম্পল নয়: বাবা আব্দুল হাকিম ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ববি সিম্পসনের ভক্ত। পঞ্চাশের দশকের সেই কিংবদন্তি ক্রিকেটারের নামেই ছেলের ডাকনাম রাখেন ‘ববি’। অনেকে বলেন, রাজ কপূর পরিচালিত ‘ববি’ ছবি দেখেই নাকি ‘ববি’ নাম। কিন্তু সেই তত্ত্ব নস্যাৎ করে ববি বলছেন, ‘‘আরে! ওই ছবিতে ডিম্পল কাপাডিয়ার নাম ছিল ‘ববি’। আর ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। আমার জন্ম তো ১৯৫৯ সালে।’’
নক আউট: রাজ্য স্তরের বক্সার ছিলেন ববির বাবা। প্রিয় বক্সার প্রত্যাশিত ভাবেই মহম্মদ আলি। বাবা চেয়েছিলেন ববিও তাঁর মতো বক্সার হোক। বছর ছয়েক বয়সে ছেলেকে স্থানীয় ক্লাবে নিয়েও গিয়েছিলেন বক্সিং প্রশিক্ষণের জন্য। কিন্তু প্রথম দিনই প্রতিপক্ষের ঘুসিতে নাক ফেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে। রক্তাপ্লুত ববি বাড়ি ফেরার পর মা আর বক্সিং ক্লাবে যেতে দেননি। পরে অবশ্য বক্সিংয়ের বিকল্প হিসেবে জুডো শিখেছিলেন। সে সব এখন আর খুব একটা কাজে লাগে না। পিতার প্রতিষ্ঠিত বক্সিং ক্লাব নতুন করে গড়ে দিয়েছেন। নাম— ‘আব্দুল হাকিম মেমোরিয়াল বক্সিং ক্লাব’।
অগ্রণী: ববির নামের সঙ্গে সমার্থক। ‘চেতলা অগ্রণী’ ছাড়া তাঁর জীবন অসম্পূর্ণ। নিজের হাতে তৈরি ক্লাব। খেলাধুলো, রক্তদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই আছে। সেই ক্লাবে সমাজসেবা করতে করতেই কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। মমতার নজরে আসা। প্রথমে ৮২ নম্বর ওয়ার্ডের যুব কংগ্রেস সভাপতি। তার পর মমতার হাতযশে রাজ্য যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। ২০০০ সালে মমতার নির্দেশে ভোটে দাঁড়িয়ে কাউন্সিলর। তারপর আর ফিরে তাকতে হয়নি। বিধায়ক, মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র।
অরূপ তোমার বাণী: ববির ক্লাবের মহোৎসব হল দুর্গাপুজো। এলাকার লোকজন যাকে ‘ববির মেয়ের বিয়ে’ বলে থাকেন। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— দুর্গাপুজোর সব দায় এবং দায়িত্ব ববির। অগ্রণীর দুর্গাপুজোটা যে জাঁকজমক করে করতে হবে, সেই ভাবনা ববির মাথায় প্রথম এসেছিল দুর্গাপুর ব্রিজের অপর প্রান্তে অরূপ বিশ্বাসের ‘সুরুচি সঙ্ঘ’ দেখে। সেই শুরু এক স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। যে মন্থন থেকে উঠে এসেছে অগ্রণীর অমৃত।
জল-যোগ: এমনিতেই খুব কম ও হাল্কা খেতে পছন্দ করেন। সকালে দুটো রুটি আর আলুর তরকারি। শেষে জল আর চা। দুপুরে-রাতে অল্প ভাত । তা-ও সেদ্ধ সব্জি দিয়ে। কখনও সখনও মাছের পাতলা ঝোল। ভোটেও সেই তালিকায় বদল আসেনি। যোগ হয়েছে ডাবের জল আর গ্লুকোজ-মেশানো জল। প্রচারের শেষে বাড়ি ফিরে বাধ্যতামূলক এই দুই পানীয়। প্রচারের সময় সঙ্গে থাকছে নুন-চিনির জল। দল থেকে জল (শোভন) চলে গিয়েছেন। অন্তত শরীরে জলের ঘাটতিটা মেটাতে হবে তো!
তিন নম্বর: মমতা এবং অভিষেকের পর ভোট প্রচারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ববিরই। কী করে হল? ববি বলছেন, ‘‘দিদি বলেছেন, কলকাতা বন্দর সেফ সিট। বেশি প্রচারের দরকার নেই। অন্য জায়গায় গিয়ে প্রচার কর! দল একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাই সব জায়গায় গিয়ে প্রচার করতে পারছি।’’
নেট-নভিস: নেটমাধ্যমে একেবারেই সড়গড় নন। কিন্তু যুগটা যে নেটমাধ্যমের, সেটা মেনে নেন। তাঁর নেটদুনিয়া পরিচালনা করেন বড় মেয়ে প্রিয়দর্শিনী। আর ববি কোনও রাখঢাক না করেই বলেন, ‘‘বড় মেয়েই আমার সোশ্যাল মিডিয়ার সবকিছু দেখাশোনা করে। কিন্তু কোনও বিষয়ে কিছু লেখার আগে আমার সঙ্গে কথা বলে, আমার মতামত নিয়েই করে।’’
আপনি আচরি ধর্ম: তাঁর ধর্ম বা অন্য কারও ধর্ম নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমার ধর্মই আমাকে শিক্ষা দিয়েছে সকলকে আপন করার।’’ অগ্রণীর দুর্গাপুজোয় যেমন সক্রিয় নেতৃত্ব দেন, তেমনই কলকাতা বন্দরের বিধায়ক হিসেবে ভুকৈলাস মন্দিরে রুদ্রাভিষেকে অংশ নেন। অনেকে যেমন তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে উচ্ছসিত, তেমনই অনেকে তির্যক মন্তব্যও করেন। সমালোচনায় শীতল থাকেন ববি। ঠান্ডা গলায় জবাব দেন, ‘‘কারও সমালোচনায় আমার কিছু এসে যায় না। যে ধর্ম আমি মেনে চলি, সেই ধর্মই আমাকে শিক্ষা দিয়েছে সকলইকে আপন করার।’’
লগে রহো মুন্নাভাই: গান শুনতে আর সিনেমা দেখতে ভালবাসেন। কমেডি ছবির ভক্ত। ‘মুন্নাভাই’ সিরিজ যে কতবার দেখেছেন, তা ইয়ত্তা নেই। তবে দিনে দিনে ব্যস্ততা বেড়েছে। তাই এখন বাড়িতে গান শোনা বা ছবি দেখা হয়ে ওঠে না। গাড়িতে নচিকেতা বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শুনে নেন। ভাল লাগে।
তথ্য: অমিত রায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী