সুবর্ণজয়ন্তী: বাংলার রাজনীতির কিংবদন্তির এ বছর ভোট লড়ার সুবর্ণজয়ন্তী। প্রথম লড়েছিলেন এই বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকেই। ১৯৭১ সালে। চলতে চলতে এবার ৫০তম বছরে পা রাখল তাঁর ভোটযুদ্ধের আয়ুষ্কাল। অনেক কেন্দ্র ঘুরেফিরে আবার সেই বালিগঞ্জেই। ২০১১ থেকে এই কেন্দ্রেরই বিধায়ক তিনি। ভোট রাজনীতির ৫০তম বছরকে স্মরণীয় করে রাখতে জিততে তো হবেই!
তেলে পেট তাজা: ১৯৮২ সালে জোড়াবাগানের বিধায়ক হন সুব্রত। তখন থেকেই সেখানকার মাড়োয়াড়ি-মহেশ্বরী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। জোড়াবাগান এলাকার তেওয়ারি ব্রাদার্সের খাবারের দোকান সুপ্রসিদ্ধ। সেই সময় কেন্দ্র ঘুরতে ঘুরতে সুব্রত গিয়ে বসতেন সেই দোকানের মালিকের গদিতে। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার গন্তব্যে রওনা হতেন। ১৫ বছর ধরে সেই রুটিন অক্ষুন্ন ছিল। সময় নদীর জলের মতো বয়ে গিয়েছে। জোড়াবাগান ছেড়ে সুব্রত এখন বালিগঞ্জের বিধায়ক। কিন্তু তেওয়ারিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অমলিন। ঝ়ড়-জল, বন্ধ বা লকডাউন— প্রতি রবিবার সকালে নিয়ম করে সেখান থেকে প্রাতঃরাশ আসে সুব্রতের বাড়িতে। কচুরি, তরকারি, সিঙ্গাড়া, জিলিপি-সহ হরেকরকমের মিষ্টি। ভাজাভুজি খেতে ভালবাসেন এবং হজমও যে করে ফেলতে পারেন, তা অস্বীকার করেন না কলকাতার প্রাক্তন মহানাগরিক।
আরও দশটি বছর: ২০০০ সাল থেকে পাঁচ বছর কলকাতার মহানাগরিক ছিলেন সুব্রত। সহ-নাগরিকেরা জানেন, কলকাতার সেটা সোনার সময় গিয়েছে। পুর-প্রশাসক হিসেবে প্রশংসা শুনতে ভালই লাগে। কিন্তু সঙ্গে থেকে যায় আক্ষেপও, ‘‘একজন মেয়র অন্তত তিনটে টার্ম থাকলে তবেই কলকাতাকে সাজাতে পারবে। যে কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় লাগে।’’ তিনি পেয়েছিলেন মাত্রই পাঁচ বছর! তবে সুব্রত মনে করেন, কাজের জন্য সবচেয়ে দরকারি ‘প্যাশন’। বলেন, ‘‘প্যাশন না থাকলে মেয়র হয়ে লাভ নেই। আসলে মেয়রগিরি একটা ফুলটাইম কাজ। অন্য কোনও কাজ থাকলে হবে না। সংসারও করা যাবে না। আর লোভ সংবরণ করতে হবে।’’
ছন্দের বাণী: মহানাগরিক থাকার সময় যখন গড়িয়াহাটের বুলেভার্ড থেকে হকারদের সরিয়ে দিয়েছিলেন বেদখল ফুটপাথ মুক্ত করার জন্য, স্ত্রী ছন্দবাণী প্রবল আপত্তি করেছিলেন— ‘‘এবার আমি বেডকভার আর পর্দা কোথা থেকে কিনব!’’ সুব্রত ততটা কান দেননি। বলেছিলেন, ‘‘ওদের তো পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে কিনবে। অসুবিধের কী আছে।’’
ছন্দের পতন ও উত্থান: মহানাগরিক থাকাকালীন দলনেত্রীর সঙ্গে অন্তত তিনবার এমন শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই বেধেছিল যে, বোর্ড প্রায় উল্টে যায়-যায়। একটা সময়ে বাক্যালাপও কার্যত বন্ধ ছিল। প্রতিবারই আগুনে জল ঢেলেছেন তৎকালীন মেয়র পারিষদ শোভন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু পাঁচ বছর পর সুব্রত তৃণমূল ছেড়েছেন। এনসিপি-র ঘড়ি চিহ্ন নিয়ে কাউন্সিলর ভোটে জিতেছেন। পরে মিটমাট হয়ে তৃণমূলে ফিরলেও ছোট লালবাড়িতে আর ফিরতে পারেননি। অথবা, ফিরতে চাননি।
ফোনটে কোনটে: মোবাইলের হাইটেক প্রচারে বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। এখনও সনাতনী ‘ডোর টু ডোর’ প্রচারেই বিশ্বাসী। বলেন, ‘‘ফোনেইসব হলে তো আর মানুষ কাজ করত না! সবকিছু এমনিতেই হয়ে যেত।’’ দল প্রশান্ত কিশোরের মতো ভোটকৌশলীকে এনে ভোটের রণনীতি সাজিয়েছে। তারাও জোর দিচ্ছে নেটমাধ্যমে। দলীয় নির্দেশ বলে তাদের কথা মানতে হচ্ছে বটে। কিন্তু পাশাপাশিই বলছেন, ‘‘ফোনের জিনিস ফোনেই থাক।’’
কোন পথে যে চলি: সচরাচর রাজনীতিকরা চান একটি কেন্দ্র থেকেই বারবার প্রার্থী হতে। কিন্তু সুব্রতের পরিষদীয় জীবনে তা হয়নি। ১৯৭১ সালে বালিগঞ্জ থেকে প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়েই জয়। ১৯৭২ সালে ফের বালিগঞ্জ থেকে জিতে মন্ত্রী। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয়ে নিজেও পরাজিত। ১৯৮২ সালের বিধানসভা ভোটে উত্তর কলকাতার জোড়াবাগান। সেখান থেকে পরপর তিনবার জিতে ১৯৯৬ সালে চৌরঙ্গি। জয়লাভ। ২০০১ সালে তৃণমূলের বিধায়ক। ২০০৬ সালে চৌরঙ্গি থেকে কংগ্রেসের হয়ে হার। ২০১১ সালে তৃণমূলে ফিরে বালিগঞ্জে জয়। মন্ত্রীও।
কোন কথা যে বলি: বারবার দলবদল সুব্রতের গলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সুর এনে দিয়েছে। তবে কংগ্রেস আর তৃণমূলের মধ্যেই মূলত তা ঘোরাফেরা করেছে। আবার প্রতাপশালী শ্রমিকনেতা হিসেবে বামপন্থীদের সঙ্গেও কখনও কখনও তাঁর দাবিদাওয়া মিলে গিয়েছে। তবে রসিকতা করে এবং মুখ ফস্কে বিভিন্ন সময় সতীর্থ রাজনীতিকদের সম্পর্কেও লঘু মন্তব্য করে বিপাকে পড়েছেন। তবে স্বভাবচপল সুব্রত আবার ঠিক সময়ে গোললাইন সেভও করে নিয়েছেন।
মৌলানা মুখার্জি: উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে একদা মুলায়ম সিংহ যাদবকে বলা হত মৌলানা মুলায়ম। বাংলায় সুব্রতও সেই অভিধার অধিকারী হতে পারেন। বরাবরই ইফতার পার্টিতে যান। অংশ নেন মহরমের মিছিলেও। আবার পার্ক সার্কাস ময়দানে ইদের নমাজেও তাঁর হাজিরা বাঁধা। ঘটনাচক্রে, এখন পার্ক সার্কাস ময়দান তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে। ২৬ এপ্রিল ভোট হওয়ার কথা বালিগঞ্জে। ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে রমজান। সেকথা মাথায় রেখেই মুসলিম-অধ্যুষিত সুব্রত প্রচার শেষ করে দিয়েছেন রমজান মাস শুরুর আগেই। পরীক্ষা শুরুর আগেই পড়াশোনা শেষ।
এভারগ্রিন: ঘনিষ্ঠরা বলেন, বাংলার রাজনীতিকদের মধ্যে তিনি এভারগ্রিন। বজবজ সারেঙ্গাবাদের ছেলে কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে থাকা শুরু করার সময়েই যুক্ত হয়ে পড়েন গড়িয়াহাট এলাকার একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবের সঙ্গে। ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ক্লাব নামেই সম্যক পরিচিত। একডালিয়ার দুর্গাপুজোকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন তিনি। যে পুজো এখনও থিমের স্রোতে গা ভাসায়নি। সুব্রতের বিশ্বাস, থিমের কারণে পুজোর আসল গরিমা ম্লান হয়ে যায়। তাই প্রতিযোগিতার দৌড়ে না গিয়ে সাবেকি পুজোই একডালিয়াকে এভারগ্রিন রেখেছে। সুব্রতকেও।
সুলভ সুলভ: কলকাতার রাস্তাঘাটে শৌচালয়ের প্রয়োজনীয়তা, বিশেষত মহিলাদের জন্য, প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন মহানাগরিক সুব্রত। ২০০০ সালের এক রাতে গাড়ি চালিয়ে সস্ত্রীক বাড়ি ফেরার পথে আলিপুরের রাস্তায় এক পথচারীকে জলবিয়োগ করতে দেখে গাড়ি থামিয়ে চালকের আসন ছেড়ে নেমে গিয়ে রাস্তায় পড়ে-থাকা নিমডাল দিয়ে কযেক ঘা দিয়েছিলেন। পথচারী চম্পট দিলেও সম্বিত ফিরেছিল মহানাগরিকের। উপলব্ধি করেছিলেন শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে রাস্তাঘাটে শৌচালয় তৈরির প্রয়োজনীয়তা। তাঁর শাসনকালে ২,১০০-২,২০০ সুলভ শৌচালয় নির্মিত হয়েছিল কলকাতায়। যেখানে নামমাত্র দক্ষিণা দিয়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে পারেন পথচলতি মানুষ।
যস্মিন দেশে: প্রাক্তন ক্রিকেটার লক্ষ্ণীরতন শুক্ল বিধায়ক হওয়ার পর একদিন বিধানসভায় এসেছিলেন হাল ফ্যাশনের হাঁটু-ছেঁড়া জিন্সের ট্রাউজার্স পরে। দেখে অধিবেশন কক্ষ থেকে লক্ষ্ণীকে ডেকে বাইরে নিয়ে যান সুব্রত। কড়া মেজাজেই প্রশ্ন করেন, ‘‘এমন পোশাক পরে এসেছো কেন?’’ কোনওকিছু বুঝে ওঠার আগেই জুনিয়ার সহকর্মীকে বলেন, ‘‘এটা গণতন্ত্রের মন্দির। মানুষ তোমাকে এখানে আসার সুযোগ দিয়েছে। এভাবে এই পবিত্র স্থানের অপমান কোর না।’’ বর্ষীয়ান রাজনীতিকের পা ছুঁয়ে লক্ষ্ণী বলেছিলেন, ‘‘এমন ভুল আর হবে না।’’
সিদ্ধার্থে কৃতজ্ঞতা: প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জনের সমস্ত কৃতিত্ব দেন প্রয়াত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে। বলেন, ‘‘কতই বা বয়স তখন আমার! প্রতিমন্ত্রী ছিলাম। আইনে আছে, পূর্ণমন্ত্রী চাইলেই প্রতিমন্ত্রী কাজের সুযোগ পাবেন। ওঁর দাক্ষিণ্যে আমি ছিলাম মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ সব দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী আমার কাছেই পাঠাতেন সব গুরুত্বপূর্ণ ফাইল। সেই প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা কখনও ভুলিনি।’’
বাকি রহিয়া গেল: ছ’দশকের রাজনীতির জীবনে বিধানসভা থেকে শুরু করে পুরসভা। লোকসভা থেকে রাজ্যসভা। সব ভোটেই লড়ার অভিজ্ঞতা আছে। পুরসভা থেকে বিধানসভা ভোটে বার বার জিতলেও একবারের জন্যও ধরা দেয়নি ভারতের সংসদ। তিন-তিনবার লোকসভা ভোটে প্রার্থী হয়েও জিততে পারেননি। একবার রাজ্যসভা ভোটে দাঁড়িয়েও হেরে গিয়েছেন। সুবর্ণজয়ন্তীতে আক্ষেপ বা অপ্রাপ্তি এটুকুই।
তথ্য: অমিত রায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী