শামিম ওসমান
ভোটে খেলতে চাইছে সব দলই।
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আসুন, খেলা হয়ে যাক।’’ তাঁর অন্যতম সেনাপতি অনুব্রত মণ্ডলের হুঙ্কার, ‘‘ভয়ঙ্কর খেলা হবে।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ পাল্টা দিচ্ছেন, ‘‘আমরাও বলছি খেলা হবে। তোমাদের (তৃণমূল) খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে।’’ ‘খেলা হবে’-র বার্তা দিয়ে নবান্ন অভিযান করেছেন বাম ছাত্র-যুবরা। হুমকিতে, চ্যালেঞ্জে, গানে, প্যারোডিতে, পোস্টারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে— খেলা হবে, খেলা হবে!
বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক স্লোগান ‘খেলা হবে’ এ ভাবেই কলরব তুলেছে এ-পার বাংলায়। ঠিক ‘হোক কলরব’-এর মতো। নারায়ণগঞ্জের আওয়ামি লিগের সাংসদ শামিম ওসমান ২০১৩-১৪ সালে প্রথম এই স্লোগানটি দেন। ফোনে শামিম বলছিলেন, ‘‘বিএনপি-জামাত তখন বাংলাদেশে ‘জ্বালাও পোড়াও’ আন্দোলনের নামে অরাজকতা চালাচ্ছিল। সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়াচ্ছিল। সেই সময় আমি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদে নামি। পাল্টা চ্যালেঞ্জ করি, তোমরা ভেবো না, এই সব করে তোমরা জিতে যাবে। আমরাও টক্কর দেব। খেলা একতরফা হবে না।’’ কিন্তু ‘খেলা হবে’-র অর্থ কী? হিংসায় টক্কর দেওয়া? একটা যুদ্ধের হুঙ্কারের মতোই তো এ পার বাংলায় দাঁড়িয়েছে বিষয়টা। শামিমের জবাব, ‘‘আমাদের খেলা শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে।’’ সাংসদের দাবি, ‘‘প্রথম যখন চ্যালেঞ্জ করি, তখন মানুষ এই স্লোগানকে সমর্থন করেছিলেন। স্লোগানটি জনপ্রিয়ও হয়েছিল।’’
অথচ যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গে ‘খেলা হবে’ স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, তার হাবে-ভাবে উদ্বিগ্ন সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র। তাঁর কাছে এই খেলা ‘আসলে মারণ খেলা।’ অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘খেলা হবে কথাটি শুনলেই আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হোরিখেলা’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। সেখানেও রক্তাক্ত খেলা হয়েছিল।’’ ‘খেলা হবে’ গানের সঙ্গে কলেজ প্রাঙ্গণে পড়ুয়াদের উদ্দাম নৃত্যের খবরে সমাজতত্ত্ববিদের আক্ষেপ, ‘‘আসলে এক সমাজহীন সমাজের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি। যেখানে সব কিছুর মধ্যেই আমরা মজা খুঁজতে চাই। নির্বাচনের মতো বিষয়ও এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মজার খেলা। খেলা হবে স্লোগান তারই প্রতিফলন।’’
খেলা হবে: ঠাকুরই ভাইরাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ।
‘খেলা হবে’ স্লোগানের নিন্দা করেছেন প্রাক্তন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘সমাজ গঠনের লড়াই, আত্মত্যাগ, মানুষের আন্দোলন— এই সব বিষয়ে লঘু করে দেওয়ার জন্যই ‘খেলা হবে’-র মতো স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। এ সবই বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা।’’ এই প্রসঙ্গে তিনি টেনে এনেছেন ‘টুম্পা’ গানের প্যারোডির মাধ্যমে বামেদের ব্রিগেড সমাবেশের প্রচার করার বিষয়টিকেও। অসীমবাবুর মতে, ‘‘এই টুম্পা গান, বা খেলা হবে সব একসূত্রে বাঁধা। সবই রাজনীতিকে লঘু করার চেষ্টা।’’ প্রাক্তন নকশাল নেতারও আশঙ্কা, ‘খেলা হবে’-র মতো স্লোগান ‘অর্থহীন হিংসা’ বাড়িয়ে তুলবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের এই খেলার ইচ্ছেকে ভাল ভাবে নিচ্ছেন না সাধারণ মানুষও। যোধপুর পার্কের বাসিন্দা, চিকিৎসক অসিতরঞ্জন গোসাই বলছেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতাদের আমরা খেলোয়াড় হিসেবে দেখতে চাই না। খেলা দেখার জন্য আমরা তাঁদের ভোটে জিতিয়ে আনিনি। খেলা দেখার জন্য এ বারেও আমরা ভোট দিতে যাব না। বাংলায় আমরা চাই গণতান্ত্রিক, জনদরদি, সংবেদনশীল, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার।’’ অসিতবাবুর কটাক্ষ, ‘‘যে জোর গলায় নেতারা খেলা হবে বলছেন, সেই জোর গলায় তো তাঁদের বলতে শুনছি না, বেকারদের চাকরি হবে, নিরন্ন মানুষ অন্ন পাবে।’’
সে কারণে ‘খেলা হবে’র আধুনিক প্রবক্তা শামিমও বলছেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিক। সুযোগ পেলেই আমি কলকাতায় যাই। আমি আশা করব, পশ্চিমবঙ্গের ভোটে খেলা যেন শান্তি, পারস্পরিক সৌহার্দ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ভোট গণতন্ত্রের উৎসব। তাকে যেন সাম্প্রদায়িক কালিমা, হিংসার রক্তে রঞ্জিত করা না-হয়। খেলার নামে মানুষ যেন অকারণ হিংসায় না-মাতেন।’’