মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
২০১১ সালের পরে হাওড়া শহর ছিল তৃণমূলের গড়। ঠিক নির্বাচনের আগে শাসকদলের সেই গড় থেকেই শুরু হয়েছিল দলীয় ‘বিদ্রোহে’র তুমুল আমপান। দলের একের পর এক নেতা বিরোধী শিবিরে যোগদান করায় রাজনৈতিক বির্তকের ‘ভরকেন্দ্র’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের এই শহর। শেষ সময়ে যখন শাসকদল দলীয় সংগঠন ফের গুছিয়ে নিতে মরিয়া, তখন বিরোধী শিবির শাসক দলের বিদ্রোহী নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সেই গড়ে চরম আঘাত হানতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ বার হাওড়া সদর কেন্দ্রে বিধানসভা নির্বাচন তাই সার্বিক অর্থেই বেশ জটিল।
হাওড়া সদরে ৯টি কেন্দ্রে ভোট ১০ তারিখ। গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে তৃণমূল ৮টি কেন্দ্রেই এগিয়ে। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতি অনেকটাই জটিল। সেই জটিলতার আবর্তে যেমন দলবদলুদের ভিড় রয়েছে, তেমনই রয়েছে ধর্মের নামে মেরুকরণের রাজনীতি। উল্টো দিকে রয়েছে উন্নয়ন আর ‘দিদির’ প্রতি আবেগ ও আস্থা। হাওড়া সদরে ভোটের ফলাফলই বলে দেবে জয় হল কিসের।
হাওড়ায় শাসকদলের মধ্যে গোষ্ঠী-বিবাদ শুরু হয়েছিল বছর আটেক আগে। ২০১৩ সালে হাওড়া পুরসভা নির্বাচনে প্রার্থিপদ নিয়ে দলের তখনকার জেলা সভাপতি (শহর)ও রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায়ের সঙ্গে ডোমজুড়ের বিধায়ক ও মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোষ্ঠী বিবাদ চরমে পৌঁছেছিল। সেই বিবাদের জেরেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মতান্তর দলবদলের পর্যায়ে পৌঁছেছিল এ বারের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পাঠানো চার্টার্ড বিমানে রাজীববাবুর সঙ্গে দিল্লি উড়ে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন হাওড়া পুরসভার তৃণমূলের প্রাক্তন মেয়র রথীন চক্রবর্তী, দলের বালির বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়া-সহ আরও অনেকে। সেই শুরু। তার পরে একে একে দলীয় নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন শিবপুরের বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা ও পাঁচ বারের বিধায়ক জটু লাহিড়ী, সাঁকরাইলের তিন বারের বিধায়ক শীতল সর্দার-সহ একাধিক নেতা। এমনকি, রাজনীতি থেকেই সরে দাঁড়িয়েছেন উত্তর হাওড়ার তৃণমূল বিধায়ক ও দলের জেলা সভাপতি লক্ষ্মীরতন শুক্লও। সকলেরই ক্ষোভ দলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি অরূপ রায়ের বিরুদ্ধে।
এ দিকে, শীতলবাবু ও জটুবাবু দল ছাড়লেও বিজেপি তাঁদের প্রার্থী করেনি। তা হলে তাঁরা কি ফের ওই দলও ছেড়ে দেবেন?
জটুবাবুর উত্তর, ‘‘বিজেপিতে তো টিকিটের জন্য যাইনি। বিজেপিতে যোগ দিয়েছি নিঃশর্তে। অপমানের প্রতিশোধ নিতে। তাই ছেড়ে যাওয়ারও কোনও প্রশ্নই নেই।’’ একই বক্তব্য শীতলবাবুরও। তিনি বলেন, ‘‘ক্ষোভে দল ছেড়েছি। আমি তো টিকিট পাওয়ার জন্য বিজেপিতে যাইনি।’’
তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ নিয়ে অরূপবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে দলকে ওঁরা জানাননি কেন। দলকে না জানিয়ে একটা আদর্শহীন দলে গিয়ে ওঁরা নাম লেখালেন কেন? নিজেরা তো এগিয়ে এসে দলের হাল ধরতে পারতেন?’’
এত জন নেতার প্রধান বিরোধী দলে যোগদানের পরেও অবশ্য তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্ব অরূপবাবুর ওপরই ভরসা রেখেছেন। ইতিমধ্যে তাঁর নেতৃত্বে ডুমুরজলায় মুখ্যমন্ত্রীর জনসভা হয়েছে। তাঁর এলাকায় দীর্ঘ এক দশক বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা রামকৃষ্ণপুর সমবায় ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের পাওনা টাকা অনেকটাই মিটিয়ে দিয়ে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। বলছেন, ‘‘এ বার আমার জয়ের ব্যবধান বাড়বে।’’
তবে দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে হাওড়া পুরসভায় নির্বাচিত পুরবোর্ড না থাকার ফলে পুর পরিষেবার ব্যর্থতা সামনে এনে শহরের ভোটে প্রধান বিষয় করছেন বিরোধীরা। উন্নয়নের প্রশ্নে তাই তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন মধ্য হাওড়ার বিজেপি প্রার্থী দলের রাজ্য নেতা সঞ্জয় সিংহ। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘তৃণমূল বলে দিক, কী উন্নয়ন হয়েছে হাওড়ায়? পঞ্চাননতলায় জমা জলের সমস্যা কি মিটেছে? হাওড়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প কারখানা একটাও খুলতে পেরেছেন অরূপবাবুরা?’’
কিন্তু হাওড়ায় কি কোনও উন্নয়ন হয়নি?
প্রশ্ন শুনে ঠান্ডা চোখে তাকালেন কোনা এক্সপ্রেসের পাশে উনসানির চায়ের দোকানের মালিক বসির আহমেদ। সামনের পেভার ব্লক বসানো ঝকঝকে ২০ ফুট চওড়া রাস্তা দেখিয়ে বললেন, ‘‘আন্দুল বাজার পর্যন্ত যাওয়া ৪ কিলোমিটার এই রাস্তাটায় আগে হাঁটা যেত না। চার দিকে ত্রিফলা বসেছে। উন্নয়ন হয়নি বলছেন?’’ সেই সঙ্গে দোকানির মন্তব্য, ‘‘শুধু তাই বা কেন, আমপান বা লকডাউনের সময়ে যখন সব স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন বিনা পয়সায় চাল-ডাল-খাবার তো দিদিই পাঠিয়েছিলেন।’’
লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৩ হাজার ভোটে পিছিয়ে থাকা উত্তর হাওড়া বিধানসভায় এ বারের তৃণমূল প্রার্থী প্রাক্তন মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরী। সেখানে বিজেপির পক্ষ থেকে দাঁড়িয়েছেন যুব মোর্চার নেতা উমেশ রাই। দু’জনেই উত্তর হাওড়ার বাসিন্দা। ওই কেন্দ্রে অবাঙালি ভোটার ৬২ শতাংশ। ফলাফলের হিসাব অনেকটাই তাঁদের হাতে।
গলায় রজনীগন্ধার মালা পরে পায়ে হেঁটে লিলুয়ায় নির্বাচনী প্রচারের সময় গৌতমের দাবি, ‘‘আমি ২০ বছর ধরে এলাকার মানুষের কাজ করছি। মানুষ আমাকে চেনেন। তা ছাড়া। দিদির উপর মানুষের আস্থা আছে।’’
উমেশও মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন। তিনিও ঘুরছেন নিজের গড়ে। বলছেন, ‘‘সিন্ডিকেট রাজ ও প্রোমোটিং চক্র ছাড়া হাওড়ার কোনও উন্নতি হয়নি।’’ তৃণমূলের সিন্ডিকেট রাজ ও বিজেপির ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বড় মিছিল করেছেন সংযুক্ত মোর্চার সিপিএম প্রার্থী পবন সিংহও। তিনি বলছেন, ‘‘এ বার জয় হবে আমারই।’’
প্রচার সেরে কদমতলায় প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন শিবপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারি। তিনি বলেন, ‘‘যিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির হয়ে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, দিদির ইচ্ছায় মেয়র হওয়ার পর তিনি পুরসভায় দিনে দেড় ঘণ্টাও সময় দিতেন না। টাকা পেয়েও উনি কাজ করেননি। না হলে শহরের আরও উন্নয়ন হত।’’
যাঁর উদ্দেশ্যে এই মন্তব্য, জোড়া ফুল ছেড়ে পদ্মে যোগ দেওয়া শিবপুর কেন্দ্রের প্রার্থী হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র রথীন চক্রবর্তীর এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া, ‘‘উনি তো বহিরাগত। হাওড়াকে ভাল করে চেনেনই না। শহরের মানুষ জানেন কী কাজ হয়েছে।’’
ওই কেন্দ্রে প্রচারে প্রভাবে সমানে টক্কর দেওয়া সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আর ফরওর্য়াড ব্লকের জগন্নাথ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমি সারাজীবন এলাকায় পড়ে থেকেছি, মানুষের পাশে থেকেছি। মানুষ জানেন আগে কী হয়েছে, এখন কী হয়।’’
এ বারের নির্বাচনে তৃণমূলের অন্যতম গড় দক্ষিণ হাওড়ার প্রার্থী পাঁচ বারের বিধায়ক ও একবারের তৃণমূল সাংসদ প্রয়াত অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে নন্দিতা চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন গত লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তৃতীয় হওয়া এবারের সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সিপিএমের সুমিত্র অধিকারী।
নির্বাচনী প্রচারের ফাঁকে সিপিএমের এই তরুণ প্রার্থী বললেন, ‘‘তৃণমূল যেমন গত পাঁচ বছরে হাওড়া শহরকে শেষ করে দিয়েছে, তেমনই সরকার গড়ার পরে গত দু’বছরে মানুষ বিজেপিকে দেখেছে। গ্যাস, পেট্রলের দাম উর্ধ্বমুখী, একে একে সব সরকারি সংস্থা বেচে দেওয়া দেখে মানুষ বুঝতে পেরেছে এ দলটা সাঙ্ঘাতিক।’’
চড়া রোদের মধ্যে দলীয় সর্মথকদের নিয়ে দানেশ শেখ লেনে প্রচার করছিলেন দক্ষিণ হাওড়ার তৃণমূল প্রার্থী নন্দিতা। রাস্তার পাশে একটা বহুতলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘বাবার নামে ক্যানসার ফাউন্ডেশনের কাজের জন্য এলাকার মানুষ আমাকে চেনে। এ ছাড়া দিদির সামাজিক কর্মসূচি কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো সামাজিক প্রকল্পের জন্য শুধু দলের ভোট নয়, বাম-কংগ্রেস সব ভোটই পাব।’’
পাঁচলা কেন্দ্রে গুলশন মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন বিজেপি ও ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফে যোগ দেওয়া তৃণমূলের দুই বিক্ষুব্ধ নেতা। তৃণমূলের পাঁচলা পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান আব্দুল জলিল যেমন দল ছেড়ে আইএসএফের হয়ে গুলশনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, তেমনি এলাকার বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা মোহিত ঘাটিও দল ছেড়ে বিজেপির হয়ে গুলশনের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন। এঁরা সকলেরই গুলশনের বিরুদ্ধে আমপানের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলে দল ছেড়েছেন।
গুলশন অবশ্য এ সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। বলছেন, ‘‘সব মিথ্যা বলছে। নিজেরা সাম্প্রদায়িক তাই বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দলে ভিড়েছে। হাওড়া গ্রামীণের ৪২ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের সবটাই পাব।’’
অন্য দিকে, উলুবেড়িয়া পূর্বে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী প্রাক্তন ফুটবলার বিদেশ বসুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল ছেড়ে আইএসএফে যোগ দেওয়া উলুবেড়িয়া পুরসভার তৃণমূলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আব্বাসউদ্দিন আনসারি। ওই একই আসনের জন্য লড়াইয়ে আছেন গত ২০১৯ এর বিধানসভা উপ-নির্বাচনে বিজেপির পরাজিত প্রার্থী প্রত্যুষ মণ্ডল। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আব্বাসের দাবি, ‘‘এলাকার সমস্ত সংখ্যালঘু ভোট-সহ এলাকার সব মানুষের ভোট আমরাই পাব।’’
হাওড়ার আন্দুলের পর সাঁকরাইল থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে হাওড়া সদরের গ্রামীণ অঞ্চল। সেখানকার তৃণমূল প্রার্থী স্কুল পেশায় শিক্ষিকা প্রিয়া পাল। প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক শীতলবাবুর জায়গায় তিনিই সাঁকরাইল কেন্দ্রের প্রার্থী। সারেঙ্গার হীরাপুরে গঙ্গার পাড় ঘেঁষা বাড়িতে বসে তাঁর সোজাসাপ্টা জবাব, ‘‘শীতলদা দল ছেড়ে চলে যাওয়াতেই আমি জিতব। এখানকার মানুষ আমার কাজের জন্য আমাকে ভালবাসেন। তা ছাড়া এখানে কেউ ধর্মের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তাঁরা দিদির প্রতি আবেগ ও কাজের আস্থায় তৃণমূলকে ভোট দেবেন।’’