প্রতীকী ছবি।
শহরটা যেন থমকে গিয়েছে ধুলো মাখা মেঠো পথে। অনেকটাই আধা শহর। ইস্টার্ন বাইপাস লাগোয়া একটিয়াশাল হাট। আর দশটা হাটের মতো পসরা সাজিয়ে ব্যস্ত দোকানিরা। কেউ ব্যস্ত পটল, ঝিঙেতে জল ছেটাতে। কেউ আলুতে লেগে থাকা মাটি পরিষ্কার করতে। চায়ের দোকানে সাইকেলে হেলান দিয়ে জিরোচ্ছেন কেউ। এরই মধ্যে মাইকের আওয়াজে মাথা তুলে এক আনাজ দোকানি পাশের দোকানিকে বললেন, ‘‘দাদা আসছেন। কড়া রোদেও। বুকের অপারেশন নিয়ে লোকটা চড়কি পাক খাচ্ছেন। জিতলে আর দিদির সরকার থাকলে হয়তো ফের ভাল মন্ত্রী হবেন। তবে রাম-বামদের সঙ্গে জোর লড়াই হবে।’’
এক দশকের চেনা মাঠ, বিপক্ষ খেলোয়াড়েরা অতি পরিচিত। তাও নতুন বছর শুরুর কিছুদিন পরেই কলেজপাড়ার বিপিন পাল সরণির বাড়ি থেকে উঠে গিয়েছিলেন ইস্টার্ন বাইপাস লাগোয়া ভাড়া বাড়িতে। সকাল বিকেলে তো বটেই, গভীর রাতে সেখান থেকেই চলছে হোমওয়ার্ক। গত কয়েক বছরে এলাকায় দলে ভাঙন, অন্যতম এক অনুগামীর বহিষ্কার— সব মিলিয়ে মন্ত্রী তথা ডাবগ্রাম ফুলবাড়ির তৃণমূল প্রার্থী গৌতম দেবের লক্ষ্য একটাই, ‘হ্যাটট্রিক’!
২০১১ সালে নতুন বিধানসভা ডাবগ্রাম ফুলবাড়িতে দাঁড়িয়ে সিপিএমের দিলীপ সিংহকে হারিয়েছিলেন গৌতম। পরিবর্তনের সেই সরকারে নতুন বিধানসভায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়নের মতো নতুন দফতর তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচ বছরে উত্তরবঙ্গের সাত জেলার কাজ তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রীর শাখা সচিবালয় উত্তরকন্যা গৌতম তৈরি করে ফেলেন নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রের মধ্যেই। বিরোধীরাও আড়ালে বলেছেন, ‘কাজের মন্ত্রী’।
তাই ২০১৬ সালের ভোটটা আর দেখতে হয়নি। প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে বামেদের সেই দিলীপ সিংহকেই ফের হারিয়ে পর্যটনমন্ত্রী হন গৌতম। সরাসরি দফতরের মাধ্যমে মানুষের কাজের ক্ষেত্র কমেছে মন্ত্রীর। আবার টানা এক দশকের শাসনে দলের অন্দরের রাশটাও কিছুটা কমছিল বলে মনে করছিলেন অনেকে। তাই হয়তো ২০১৯ সাল পাল্টে দেয় সব হিসেবনিকেশ।
জলপাইগুড়ি লোকসভার বিজেপি প্রার্থী জয়ন্ত রায় তৃণমূলের বিজয়চন্দ্র বর্মণের থেকে প্রায় ৮৬ হাজার ভোটের লিড পান। ধীরে ধীরে পদ্ম ফোটা শুরু করে এদিকে ওদিকে। বিরোধীরা ফুলবাড়িতে টানা গোষ্ঠী কোন্দল, সংঘর্ষ, দলের একাংশের সঙ্গে জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য, এনজেপিতে তোলাবাজি নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে সরব হলেও গৌতম নতুন করে এলাকার রাশ ধরা শুরু করেন। জয়দীপ নন্দীর মতো প্রাক্তন কাউন্সিলর দল থেকে বার হন। শিখা চট্টোপাধ্যায় দল ছাড়েন। আর প্রসেনজিৎ রায়ের মতো ঘনিষ্ঠ অনুগামীকে গ্রেফতারের জন্য বলতে ভাবেননি মন্ত্রী। দলকে নতুন ভাবে একজোট করে লড়তে নেমেও সামনে সেই পুরনো ‘পরিচিত’রাই। বামেদের দিলীপ সিংহ তো ছিলেনই। বিজেপি প্রার্থী সেই প্রাক্তন তৃণমূল নেত্রী শিখা। সব দলেই যিনি মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। লোকসভায় বামেদের বেশিরভাগ ভোটই রামে গিয়েছিল। যা উদ্ধারে আবার বামেদের ভরসা দিলীপ। তিনি বলছেন, ‘‘তেল থেকে গ্যাস, ধর্ম থেকে উন্নয়ন— কেন্দ্র কী করেছে? আর তৃণমূল তো লুঠের পার্টি হয়ে গিয়েছে।’’ প্রায়ই একই বক্তব্য শিখারও। তিনি বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ এ বার পরিবর্তনের রায় দেবে।’’
সেই রায়ের আগে এখন বিজেপির শিখার মনে খচখচানি একটা থেকেই যাচ্ছে। আড়ালে বলছেন তাঁর দলের লোকেরাই। সেটা হল, শিখার ‘গলার কাঁটা’ না হয়ে থেকে যান অলোক সেন। বিজেপির জলপাইগুড়ির জেলা সহ সভাপতি এই কেন্দ্রে টিকিট না পেয়ে বেঁকে বসেছিলেন। নির্দল হয়ে দাঁডাতেই ভোটের অঙ্ক উল্টে যাবে বুঝেই অরবিন্দ মেনন, রাজু বিস্তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে অলোককে ঘরে ফেরালেও তাঁর মন পুরো গলেছে কি না, তা ২ মে-ই বলবে। শহরের ১৪টি ওয়ার্ডেও শিখাকে পরিচয় করাতে ঘাম ঝরাচ্ছেন বিজেপি নেতা-কর্মীরা।
এর মধ্যে সকাল থেকে রাত অবধি চক্কর খেতে খেতে বাকি থাকা আশ্বাস হিসেবে পুরসভা করা, বাডি বাড়ি পানীয় জলের সঙ্গে এলাকায় দশ বছরের ৬৪০ কোটি টাকার কাজের রিপোর্ট কার্ড বিলি করছেন গৌতম। দলীয় নেতাদের বলছেন, ‘হ্যাটট্রিক’টা হলে মডেল বিধানসভা করব ডাবগ্রাম ফুলবাড়িকে।