জলকষ্ট বাঁকুড়ার বড় সমস্যা। শুকিয়ে গিয়েছে গন্ধেশ্বরী নদী। নিজস্ব চিত্র
দু’টো পাকা রাস্তা একে অপরের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে খেলতে সোজা চলে গিয়েছে গ্রামের মধ্যে। এ রাস্তা ধরতেই হত। শালতোড়ায় ঢোকার পর পরই কানে গিয়েছিল কথাটা।— এক রাজমিস্ত্রির স্ত্রী-কে জোর করে বাড়ি করতে দেওয়া হয়নি। নামে ভুল করে আটকে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা! সেই ‘শোধ তুলতেই’ এ বার তিনি বিজেপি-র টিকিটে ভোটে লড়ছেন! বিজেপি-ও লুফে নিয়েছে।
গ্রামের যাঁরা ওই বাড়ি পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন, তাঁদের অবশ্য অন্য রকম বক্তব্য। বাড়ি যেতেই প্রার্থী চন্দনা বাউরি জানিয়ে দিলেন, ওই দিন কারও সঙ্গেই কথা বলতে রাজি নন। স্বামী শ্রাবণ বাউরি বললেন, “এক জনের সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছে। যতই হোক প্রার্থী বলে কথা। আমিও ঘাঁটাচ্ছি না। আমাদের বাড়ি নিয়ে সমস্যা হয়েছিল বটে, কিন্তু তা প্রচারে বেশি বলতে চাইছি না। বলার আরও অনেক কিছু আছে।” পাশেই নির্মাণ শেষ না হওয়া একটি ঘর থাকলেও তা নিয়ে উত্তেজনাই নেই প্রার্থীর বাড়ির কারও। যে ‘শোধ তুলতে’ প্রার্থী হওয়া, সেটাই প্রচারের মূল হাতিয়ার নয়? এগিয়ে দেওয়ার পথে গ্রামের মধ্যবয়স্ক সুকুমার মণ্ডল হাসিতে ফেটে পড়ে বললেন, “কার ভুলে টাকা আটকেছে সেই প্রমাণ আর দিতে পারছেন না। ব্যক্তিগত সমস্যাকে ভোটের হাতিয়ার করতে গিয়ে এখন ফেঁসে গিয়েছেন। তবে পঞ্চায়েতে ভোট দিতে না পারার মতো কিছু রাগ তো তৃণমূলের উপর মানুষের ছিলই। কিন্তু পেটের জ্বালা মেটানোর সুরাহা পেয়ে যাওয়ায় সেই রাগ এখন গলেছে!”
লোকসভা নির্বাচনে বাঁকুড়া জেলার দু’টি আসনই গিয়েছিল বিজেপি-র দখলে। দু’টি লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত জেলার মোট ১২টি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। তবে বিধানসভা ভোটের মুখে ওই জেলায় ঘুরতে গিয়ে এখন অন্য রকম কথাও শোনা যাচ্ছে। তাতেই আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে বাঁকুড়ার লড়াই। চলতি মাসের ২৭ তারিখ ভোট হতে চলেছে শালতোড়া, ছাতনা, রানিবাঁধ এবং রাইপুর বিধানসভা কেন্দ্রে।
রাজনৈতিক মহল সূত্রে খবর, লোকসভা ভোটের সময় বাঁকুড়ায় তৃণমূলের ‘অবজার্ভার’ ছিলেন খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দল তাঁকে সরিয়ে দায়িত্ব দিয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীকে। এখন তিনিই নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোট প্রতিদ্বন্দ্বী। গত কয়েক দিনে ওই জেলায় ঘুরে মালুম হল, তৃণমূলের তরফে নিজেদের ‘শুধরে নেওয়ার’ চেষ্টা যেমন এক ভাবে ভাবাচ্ছে সেখানকার ভোটারদের, তেমনই যাঁদের উপর তৃণমূল নির্ভর করেছিল, তাঁরা যে ভাবে শিবির বদল করে চলে গিয়েছেন সেটাও হয়তো তাঁদের মানসিকতায় ঘা দিচ্ছে। এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে তৃণমূল সরকারের একগুচ্ছ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প।
রাইপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মূল বাজারে দুপুর রোদে খবরের কাগজ পড়ছিলেন এক জন। হাওয়া কোন দিকে? প্রশ্ন শুনেই মুখ তুলে ভদ্রলোক বললেন, “পেটের জ্বালা জুড়োচ্ছে যারা, সেই দিকে।” এর পর তাঁর মন্তব্য, “ধর্মের কথা তো আমরা চাইনি। পেটের ভাত চেয়েছি। বিনা পয়সায় চাল পাচ্ছি আর সেই চাল ফুটিয়ে খেতে পকেট ফুটো হয়ে যাচ্ছে। বিজেপি ভাবছে যে গ্যাসের দাম কত করেছে?” পাশেই মহামায়া হোটেলের রাঁধুনি স্বপ্না হাঁসদার আবার মন্তব্য, “পঞ্চায়েতে একটা ভোট দিতে না পারার রাগের চেয়ে রাস্তায় বেরোলেই তুলে নিয়ে ধর্ষণের ভয় অনেক বড় ব্যাপার। যেখানে যেখানে মোদীর দলের সরকার আছে, সেখানে মেয়েদের সঙ্গে কী হয়, আমরা জানি। ঘরের মেয়েরা কেউ ওদের ভোট দেবে না।”
বিজেপি-র বাঁকুড়া জেলার সভাপতি বিবেকানন্দ পাত্র যদিও বললেন, “কয়লা পাচার, পাথর পাচার বন্ধ হল না কেন? কেন অজিত মুর্মুর মতো ছেলে পঞ্চায়েত ভোটের নমিনেশন জমা করতে গিয়ে রানিবাঁধের ভরা বাজারে খুন হল? জেলা জুড়ে জলের সমস্যা মিটল না কেন? কেন এখনও এমন গ্রাম রইল, যেখানে একটা নলকূপও নেই?” রানিবাঁধ বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রমেরও মন্তব্য, “ছেলেমেয়ের চাকরি হল কই? সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি বন্ধ হল কই? আর মানুষ যাঁকে জেতাল তাঁর দলবদলু হওয়ার স্বভাব গেল কই?”
ছাতনা বিধানসভার চামকরার ঘাট সংলগ্ন একটি রঙের দোকানের মালিক বুধন বাউরি বললেন, “বামেদের মুখে দলবদলুর কথা মানায়? গত বার আরএসপি-র প্রার্থীকে লোকে ভোট দিল, তিনি জিতে তৃণমূলে চলে গেলেন। যিনি হারলেন, তিনিই আবার এ বার তৃণমূলের হয়ে দাঁড়ালেন! প্রার্থী দেখে লাভ নেই, ছোট অভিমানের চেয়ে বড় করে ভাবাই ভাল।”
শেষ বেলায় যাওয়া হয়েছিল রানিবাঁধের একদা মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা সুতানে। দেখা গেল, পলাশ ফুল দেখতে বাঁকুড়া গিয়ে অনেকেই হাজির মাওবাদীদের পুরনো ডেরা, যৌথ বাহিনীর ক্যাম্প দর্শন করতে। জঙ্গলের কয়েকশো কিলোমিটার ভিতরের পরিবেশ দেখে মনে হয়, এ তো ভাল পর্যটন গন্তব্য হতে পারে! সেখানকার তৃণমূল প্রার্থী গত বারের বিধায়ক জোৎস্না মান্ডি বললেন, “ভোটে জিতলে আগে সাপের কামড়ে মৃত্যু আটকাব। দরকার হলে এ নিয়ে আলাদা হাসপাতাল করব। জঙ্গলের হাসি সাপের কামড়ে শেষ হতে দেবো না। তারপরে হবে পর্যটন।”
ভোটের পরে এই অঙ্গীকার মনে থাকবে তো?
স্থানীয়দের যেমন অভিযোগ, ছাতনায় কবি চণ্ডীদাসের ভিটের সংস্কার নিয়ে প্রতিশ্রুতি মনে রাখা হয়নি ভোটের পরে। সেই ভিটে জুড়ে আগাছা জন্মেছে। আশপাশে ডেকরেটার্সের বাঁশ ফেলে ডাঁই করে রাখা হয়েছে। উপরের নাম-ফলকে চোখ না পড়লে বোঝাই সম্ভব নয় যে সেটি কী। এ বার কি প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে? চণ্ডীদাসের লাইন ধার করে ভিটে সংস্কার আন্দোলনের এক কর্মী বললেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। ভোটের ফলে মানুষই বিচার করবেন।”