প্রতীকী চিত্র। ফাইল চিত্র।
মুসলিম ঘরে বিয়ে হয়ে আসা হিন্দু মেয়েকে স্নেহ করছে গোটা পরিবার— একটি গয়না প্রস্তুতকারী সংস্থার বিজ্ঞাপনী ভিডিয়োয় দেখানো এই দৃশ্য দিন কয়েকের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘লাভ জেহাদে’র ধুয়ো তুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন কেউ কেউ। একে সংগঠিত ভাবে হিন্দু মেয়েদের ‘ফুসলিয়ে’ বিয়ে করা বা ধর্মান্তরিত করার ‘ইসলামি চক্রান্ত’-কে প্রশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা বলেও ব্যাখ্যা শুরু হয়। বিষয়টি এত দূর এগিয়েছিল যে, ব্যবসা বাঁচাতে ওই ভিডিয়ো সরানো হচ্ছে বলে বিবৃতি দিতে হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে।
ভোটমুখী বঙ্গে বিদ্বেষের এই কারবার এই মুহূর্তে আরও মারাত্মক চেহারা নিয়েছে বলে অভিযোগ। যেখানে যুক্তি-তর্কে মন জয়ের চেয়ে ঘৃণা ছড়ানোই হাতিয়ার হয়ে উঠছে। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র প্রস্তুতের নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আইটি শাখাগুলি পোস্ট ছড়িয়ে তা করে চলেছে। আর এমন কোনও পোস্টে ‘লাইক’ দিলে তার পরে সেই ঘৃণার জাল কেটে বেরোনো মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে অভিযোগ। সাইবার গবেষকদের অনেকের বক্তব্য, ‘‘লাইকও দিতে হবে না। এমন কোনও ভিডিয়ো পোস্ট এক বার দেখলেই তার পর থেকে ‘নিউজ় ফিডে’ স্রেফ ঘোরাঘুরি করবে ঘৃণার কারবার।’’
একটি রাজনৈতিক দলের আইটি শাখার এক সদস্যের দাবি, যে চার-পাঁচটি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে ভোট-বঙ্গে আইটি শাখার কাজ চলছে, তার মধ্যে প্রথমে রয়েছে ঘৃণার পোস্ট। তাঁর মন্তব্য, ‘‘প্রতিপক্ষ কাকে প্রার্থী করতে পারে তার তালিকা দু’মাস আগেই আমাদের দেওয়া হয়েছিল। প্রথমেই বলা হয়েছিল, ওই ব্যক্তিদের কাকে, কোন বিষয়ে বিঁধে ফেলা যায় তা খুঁজে বার করে ডেটাবেস তৈরি করতে হবে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিয়ো কিছুই বাদ যাবে না। এমনকি তাঁর কথা বা গায়ের রং-ও এখানে পণ্য।’’ ওই আইটি শাখার আর এক সদস্যের মন্তব্য, ‘‘কাজটা খুব সহজ। কোটি কোটি টাকা দিয়ে দল নানা অনলাইন অ্যানালিটিক্স কিনে রেখেছে। সে সব চালালেই যে কোনও নাম সম্পর্কে গুগলে থাকা সব কিছুই সামনে আসে।’’ এর পরেই শুরু হয় ওই প্রার্থী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর কাজ।
একটি রাজনৈতিক দলের আইটি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক জানান, এ জন্য গত জানুয়ারি থেকে রাজ্যের প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য আলাদা আলাদা আইটি ল্যাব চালু হয়েছে। বিধানসভা কেন্দ্রকে ভাগ করা হয়েছে কয়েকটি আইটি-ব্লকে। ব্লকপিছু রয়েছে একটি করে আইটি সাব-ল্যাব, যার নীচে কাজ করছেন হাজার হাজার আইটি-যোদ্ধা (আইটি কাজে যুক্ত কর্মীদের এ নামেই ডাকা হচ্ছে ওই দলে)।
আর একটি রাজনৈতিক দল আবার ২০১৮ সালে মধ্য কলকাতার দলীয় কার্যালয়ের বাইরে ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু করে আইটি-র কাজ। লোকসভা ভোটের সময়ে কেন্দ্র ধরে ধরে এক জন আইটি ইন-চার্জ নিযুক্ত করা হয়। এখন বিধানসভা
কেন্দ্রপিছু নিয়োগ করা হয়েছে আলাদা আলাদা আইটি শাখা ইন-চার্জ। তাঁদের অধীনে রয়েছে মণ্ডল আইটি শাখা এবং তার নীচে শক্তি কেন্দ্রের আইটি শাখার ইন-চার্জেরা। এমনই এক ইন-চার্জের কথায়, ‘‘ভোটের ফল ঘোষণা পর্যন্ত বিধানসভা কেন্দ্রপিছু এক লক্ষ হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপ খোলার লক্ষ্যমাত্রা রাখা আছে। এর সঙ্গেই বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে কর্মসূচি চলছে।’’
কী সেই কর্মসূচি?
আইটি শাখার এক কর্মীর ব্যাখ্যা, ‘‘কোনও নির্দিষ্ট স্লোগান শুনিয়ে শুনিয়ে কাউকে রাগিয়ে তোলার ভিডিয়ো ছড়িয়ে কাউকে ঘৃণার পাত্র করে তোলা। বাংলা তাঁর মেয়েকে নাকি অন্য কোনও আত্মীয়কে চায়, সেই প্রশ্ন গুলিয়ে দেওয়া। শারীরিক আঘাতকে হেয় করা থেকে সবটাই নাটক বলে ভাবমূর্তি নষ্ট করা। এই করতে গিয়ে নাওয়া-খাওয়ার সময় হচ্ছে না।’’ আর এক দলের আইটি শাখার কর্মীর আবার মন্তব্য,
‘‘দলের ফুল ফুটবে কি না, জানি না। আমাদের বিদ্বেষের ফুল ফুটে গিয়েছে। শারীরিক গড়ন নিয়ে কবিতা থেকে মহিলাকে নিয়ে বলা বিদ্বেষ-বিষের প্রচার— কিছুই বাদ নেই।’’
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র যদিও বললেন, ‘‘আদতে মানুষ খেপানোর কাজ চলছে। ধর্ষণের হুমকি নতুন নয়, কিন্তু ধর্ষণ করব বলেও পার পেয়ে যাওয়া যে এত সহজ, তা সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমার আগে জানা ছিল না।’’ মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম আবার বললেন, ‘‘ঘৃণার বীজ এত গভীরে ছড়িয়েছে যে চেম্বারে এমন লোকও পাচ্ছি, যিনি সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে ভোট দিতে যেতে আটকাচ্ছেন। কারণ তিনি ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক!’’