রাজনীতি বদলে দিচ্ছে বহু সমীকরণ। আর তার ছকে পড়ে পাল্টে যাচ্ছে ব্যক্তিগত থেকে পেশাদার সম্পর্কও। রাজনৈতিক মেরুকরণ বরাবরই প্রভাব ফেলেছে শিল্পীর পেশাগত ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায়, তা কংগ্রেস-বামফ্রন্ট-তৃণমূল যে আমলেই হোক না কেন। এ রাজ্যে আসন্ন নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে শিল্পীর রাজনৈতিক পরিচয় ঠিক কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে তাঁদের?
নাট্যকর্মী কৌশিক করের বিজেপিতে যোগদান ও তার জেরে ‘ঘুম নেই’ নাটক থেকে অভিনেতার বাদ পড়ার চর্চায় সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া। ‘ইচ্ছেমতো’ নাট্যদলের এই প্রযোজনা থেকে কৌশিককে বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে দলের তরফে সৌরভ পালোধী বললেন, ‘‘কৌশিক আমাদের আমন্ত্রিত শিল্পী ছিলেন। নাটকটা স্পষ্টতই বিজেপি-বিরোধী অবস্থান থেকে করছি। সেখানে বিজেপির একজন সাংগঠনিক কর্মীকে রাখা ঠিক হত না। আমাদের কাছে থিয়েটার আগে বিপ্লব, পরে শিল্প।’’ সরাসরি নয়, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্ত জানান সৌরভ। সে প্রসঙ্গে কৌশিকের বক্তব্য, ‘‘সৌরভের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। সেখানে একটা ফোন পর্যন্ত পাইনি। যে গেস্ট আর্টিস্টকে ওরা দলে ডাকে কাজ করার জন্য, পেমেন্ট দেয়, তাকে নাটক থেকে বাদ দেওয়ার সময়ে ‘চল ফোট’ বলাটা কোন মানসিকতার পরিচয়, জানি না। বাম সংস্কৃতি যে সত্যিই নষ্ট হয়ে গিয়েছে, বোঝা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমার সিদ্ধান্তও যে ভুল নয়, সেটাও বুঝতে পারছি।’’
এই ঘটনায় অনেকে যেমন বিস্মিত ও সমালোচনায় সরব, তেমনই কেউ কেউ অবাক হচ্ছেন না। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ব্যক্তিগত জায়গা থেকে দেখছি না বিষয়টাকে। সামগ্রিক ভাবে যে নীতিহীনতা, নষ্ট হয়ে যাওয়া আদর্শ বয়ে নিয়ে চলেছে বাংলা থিয়েটার, তাতে এ ধরনের ঘটনা আর বিস্ময় জাগায় না।’’ আর এক নাট্যকর্মী কৌশিক সেন স্পষ্ট জানালেন, থিয়েটার আর মতাদর্শকে আলাদা করে দেখা অসম্ভব। ‘‘যশ, নুসরত, মিমি একসঙ্গে কাজ করতে পারেন। কিন্তু থিয়েটার একটা ভিন্ন পদ্ধতি মেনে চলে, যার ভিত্তিটাই আদর্শ বা বিশ্বাসের উপরে দাঁড়িয়ে। এখানে যত না আয় হয়, উল্টে নিজেদের পকেট থেকে দিয়ে, অনেক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে থিয়েটারটা চালিয়ে যাই আমরা। এখানে মতাদর্শের লড়াইটাই তো আসল। কাজেই সৌরভের এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার ১০০ শতাংশ অধিকার আছে।’’
তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে নাটক বন্ধ করে দেওয়া, কাছের বন্ধুদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া প্রত্যক্ষ করেছিলেন ব্রাত্য বসুও। তিনি এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘আমি হলে রাজনৈতিক কারণে নাটক থেকে কাউকে বাদ দিতাম না। আমার ‘বোমা’ নাটকটি যদি এখন চলত (কৌশিক কর অভিনয় করতেন ‘বোমা’-এ), সেখানে এমন সিদ্ধান্ত কেউ নিলে তিনি বাদ পড়তেন না। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও থিয়েটারের বিশ্বাস আলাদা বলে মনে করি আমি। থিয়েটার করে টাকা পাওয়া যায় না, আবেগ আর মতাদর্শের জায়গা থেকেই তা করা হয়— সমাজে এই ধারণাকেই মান্যতা দেওয়া হচ্ছে, যার বিরোধী আমি।’’ ব্রাত্যর কথায় স্পষ্ট, রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই হোক, শিল্পীদের উপরে চাপানো যে কোনও ফতোয়া, নিষেধাজ্ঞার বিরোধী তিনি। ‘‘এ ব্যাপারে আমি ভুক্তভোগী। তৃণমূলে আসার পরে অনেক কাছের মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। এ রকম সিপিএমসুলভ ধোপা-নাপিত বন্ধ করা, একঘরে করার প্রবণতার বিরুদ্ধে আমি।’’
শুধু নাট্যমঞ্চই নয়, যে কোনও ধরনের পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রেই ‘দেগে দেওয়া’র প্রবণতায় বিপত্তির মুখোমুখি হন শিল্পীরা। ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বললেন, ‘‘বিজেপিতে যোগ দিয়েছি বলে কাজ পেতে সমস্যা হচ্ছে। যাঁরা প্রাইভেট অর্গানাইজ়ার, তাঁরাও ভয় পাচ্ছেন। বিভিন্ন মেলায় বা সরকারি অনুষ্ঠানে বরাবরই কম ডাক পেতাম। এখন একেবারেই পাচ্ছি না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাঁরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, তাঁরাও নাম কেটে দিচ্ছেন! পাছে গায়ক-মন্ত্রীমশাই রেগে যান এবং তাঁদের গ্রান্ট বন্ধ হয়ে যায়!’’ এমন পরিস্থিতিতে ‘অরাজনৈতিক’ অবস্থানও যেন বিড়ম্বনা! তবে তা সত্ত্বেও নিজের শর্তে কাজ করে চলেছেন কেউ কেউ। সঙ্গীতশিল্পী রূপঙ্করের কথায়, ‘‘দল দেখে শো করিনি কোনও দিন। আর আমার শোয়ে কোনও দলকে প্রভাব খাটাতে দিইনি।’’ আর এক গায়ক রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আমার কোনও রাজনৈতিক রং নেই। আমি একজন শিল্পী হিসেবে সব অনুষ্ঠানে পারফর্ম করি।’’
বিজেপির সদস্য-অভিনেত্রী পার্নো মিত্রের বক্তব্য, কে কাকে ভোট দেবেন বা কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করবেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা। তার ছাপ পেশাগত জীবনে পড়া উচিত নয়। নির্বাচনের আগে শো করা বন্ধ করে দিয়েছেন যশ দাশগুপ্ত। শো পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনীতির রং দেখার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘আমি নিজেই শো করা কমিয়ে দিয়েছি। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে কোনও প্রার্থীই শো করতে পারবেন না। এখন নজর, নির্বাচনমূলক কাজকর্মের দিকেই।’’ যদিও বিজেপির সম্পূর্ণ প্রার্থী তালিকা এখনও ঘোষণা করা হয়নি।
শুধু আদর্শ, মতবাদের জায়গাই নয়, রাজনীতির রং লেগে রুজি-রোজগারের পথটিও সংকীর্ণ হয়ে উঠছে অনেকেরই। নির্বাচনের মারপ্যাঁচে এই ধারার শেষ কোথায় হবে, তা অবশ্য সময়ই বলবে।