ভোটকেন্দ্রের পথে বুথকর্মীরা।
গাছে কাঁঠাল থাক বা না থাক, গোঁফে তেল দিচ্ছেন সকলেই।
বিজেপি শিবিরের হাবভাবটা এমন, যেন হুগলি শিল্পাঞ্চল ভোটের আগেই দখলে এসেছে। তৃণমূল বলছে, উত্তরপাড়া থেকে সপ্তগ্রাম— সর্বত্রই ঘাসফুলের জয়-জয়কার। অন্য দিকে, ভোট-প্রসঙ্গ তুললে মুখে কুলুপ আঁটছেন অনেক ভোটারই। হুগলি শিল্পাঞ্চলে ভোট পূর্ববর্তী আবহ বলছে, রাজ্যের অন্য অনেক জায়গার মতো এখানেও ভোটের লড়াই মূলত ‘দ্বিমুখী’। এক দিকে তৃণমূল, অন্য দিকে বিজেপি। মেরুকরণের প্রবল হাওয়ায় বামেদের ভাত-কাপড়ের লড়াইয়ের কথা বিশেষ দাগ কাটছে না।
চণ্ডীতলার সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে সামনে রেখে মোমিনপাড়া ছুঁয়ে লাল পতাকার মিছিলটা তখন সবে বাগদিপাড়ার দিকে এগিয়েছে। নবাবপুরে ‘কানা খালের’ উপরে কাঠের সাঁকোটা দেখিয়ে শেখ কাসেম বললেন, ‘‘ওখানে ঢালাইয়ের পোল হওয়ার কথা ছিল।’’ সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে পড়শি মইদুল ইসলাম বললেন, ‘‘লুট হয়েছে লুট।’’ এত ক্ষণ চাতালে বসে চুপ হয়ে শুনছিলেন শেখ সাইদুল। কাঁধের গামছাটা পিঠে ঝাপটিয়ে বললেন, ‘‘দিদিমণিকে কেউ দোষ দেচ্ছে না। আমচা-চামচারাই তো সব লুটে লে গেল। আমপানে মুখ দেখে দেখে টাকা না দেলেই হত।’’
সংখ্যালঘু মহল্লায় কান পাতলে মনে হবে নবাবপুর, খালসেরচক, কুমিরমরার মতো এলাকায় যে মানুষ তৃণমূলের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য দেখিয়ে আসছেন, সেখানে বোধ হয় ফাটল ধরেছে। কিন্তু ভোট কাদের ঝুলিতে যাবে, এই প্রশ্ন করতেই উত্তর আসছে, ‘‘মমতা না থাকলে ষারা আসবে, তারা তো আরও ভয়ঙ্কর।’’
চণ্ডীতলা, পান্ডুয়া ও চাঁপদানিতে বিধানসভায় সংখ্যালঘু ভোটার ২৪-২৮ শতাংশ। শাসক দলের সংখ্যালঘু ভোটে সংযুক্ত মোর্চা সামান্য আঁচড় কাটলে শঙ্কা বাড়বে তৃণমূলের। তবে সেই কাজ সহজ নয় বলেই মনে করছেন অনেকে। ভগবতীপুরের কাছে কুমিরমরা কবরস্থান মোড়ে চায়ের দোকান রয়েছে আসরাফুলের। তাঁর ছেলে শেখ সিরাজ তো খোলাখুলি বলেই দিলেন, ‘‘যে যাই বলুক না কেন, নবান্নে এ বারও সেই দিদি-ই।’’ তৃণমূল জিতবে বলে দাবি কররলেও আসরাফুল মানছেন, ‘‘চ্যাংড়া-ফচকে ছেলেরা ভাইজান-ভাইজান (আব্বাস সিদ্দিকি) করে লাফাচ্ছে।’’
চণ্ডীতলায় বিজেপি প্রার্থী করেছে টলিউড তারকা যশ দাশগুপ্তকে। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছেন তৃণমূলের দু’বারের বিধায়ক স্বাতী খন্দকার। লোকসভা ভোটের নিরিখে চণ্ডীতলায় তৃণমূল ১৪ হাজার ভোটে এগিয়ে। স্বাতী মনে করেন, ‘‘এ বার বামেদের যে ভোট বিজেপিতে গিয়েছিল, সেটা ফিরে যাবে। আমাদের ভোট কমবে না।’’ বিজেপির ভরসা তৃণমূলের ‘কোন্দল’। দলের শ্রীরামপুর জেলা সাংগঠনিক সহসভাপতি প্রণব চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘তৃণমূলের প্রভাবশালী এক নেতা টিকিট না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ। তিনি সামান্য এ দিক-ওদিক করলেই যশের কেল্লা ফতে।’’ সেলিমের প্রতিক্রিয়া, ‘‘মানুষকে সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুতে ভাগ করেছে তৃণমূল-বিজেপি। আমরা সেতুবন্ধন করতে তৈরি করেছি সংযুক্ত মোর্চা। মানুষ এখন আমাদের কথাই বলছেন।’’
সিঙ্গুরেও চিত্রটা ভিন্ন নয়। গুরুত্বপূর্ণ সব রাস্তাই তৃণমূল-বিজেপির ফ্ল্যাগে মোড়া। সিঙ্গুরে তৃণমূল-বিরোধী ক্ষোভের আঁচ যেমন রয়েছে,
তেমনই বিজেপির অন্দরে রয়েছে প্রার্থিপদ নিয়ে ‘কলহ’। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা-ধারী সাহানাপাড়ার যুবক অমিত গুছাইত এখন চুটিয়ে বিজেপি করছেন। বলেন, ‘‘টাটার কারখানাটা হতে দিল না তৃণমূল। ওটা হলে অনেকেই বিজেপি করত না। বাবা ও বাড়ির সবাই সিপিএম করতেন। এখন সবাই বিজেপি। পরিবর্তন চাই।’’ শুনে ফোঁস করে উঠলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাহানাপাড়ার লোকনাথ শী। বললেন, ‘‘টাটার কারখানা হয়নি তো সিপিএমের জন্যই।’’
এই দ্বিমুখী লড়াইয়ের মাঝে সিপিএমকে আলোচনার বৃত্তে আনতে পেরেছেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী এসএফআই রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য। শিল্প আর কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি। মানুষের মনে তা দাগ কাটছে বলে স্বীকারও করছেন তৃণমূল ও বিজেপি। বিজেপি নেতা কৃষ্ণ সাহানা বলছেন, ‘‘ছেলেটা শিক্ষিত, ভাল কথাও বলে। কিন্তু কোনও লাভ নেই। ও বাইরের ছেলে। তা ছাড়া, এখানে সিপিএম নেই।’’ সিঙ্গুরের সিপিএম নেতা বাসুদেব আদকের মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল-বিজেপির পতাকা-যুদ্ধ দেখে সিদ্ধান্তে আসবেন না।’’ রোজ ২৪ কিলোমিটার হাঁটছেন সিঙ্গুরের তৃণমূল প্রার্থী ‘ভূমিপুত্র’ বেচারাম মান্না। বলছেন, ‘‘যা প্রচার হয়েছে, তাতেই জিতে গিয়েছি।’’ বিজেপি প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘আমি সর্বদা লড়াই করেছি দুর্নীতি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কোনও দিন হারিনি। এ বারও হারব না।’’
শাসক-বিরোধী ক্ষোভ এবং তৃণমূল নেতাদের ‘দম্ভের’ অভিযোগ শোনা যাচ্ছে অনেক জায়গায়। সপ্তগ্রাম বিধানসভার হারিটের এক গ্রামবাসী বললেন, ‘‘মেয়ে হওয়ার পরে ওর রেশন কার্ডের জন্য গিয়েছিলাম। মুখঝামটা দিয়ে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য বলল, ‘তোর মেয়ে কি জন্মেই রেশন খাবে’।’’ সপ্তগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী তপন দাশগুপ্তর দাবি, ‘‘২০-২৫ হাজার ভোটে জিতব।’’ এই আসনে গত লোকসভা ভোটে বিজেপির থেকে প্রায় ২১ হাজারে পিছিয়ে তৃণমূল।
চাঁপদানিতে মোর্চা শিবিরের সেনাপতি খোদ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান। প্রচারে বেরিয়ে কখনও ঢাক বাজাচ্ছেন, কখনও অলিগলিতে ঢুকে বলছেন, ‘‘উঁকি মারলে কী হবে, এই যে আমি... আমি এসেছি।’’ এক সিপিএম নেতার দাবি, ‘‘তৃণমূলে টিকিটের দাবিদার ছিলেন ছ’জন। যাঁরা টিকিট পাননি, তাঁরা আড়ালে থেকে আব্দুল মান্নানের হয়ে ভোট করাবেন।’’ তৃণমূল জেলা সভাপতি দিলীপ যাদবের অভিযোগ, ‘‘এই সব রটানো হচ্ছে।’’ আর বিজেপি প্রার্থী দিলীপ সিংহের দাবি, ‘‘৫০ হাজার ভোটে জিতব।’’