ভোটারবাবা পার করেগা: কেন্দ্রের নাম তারকেশ্বর। যেখানে ছোটে বাঁক কাঁধে। মুখে বুলি ‘ভোলেবাবা পার করেগা’। এখন স্বপন হাঁটছেন সেই তারকেশ্বরের পথে পথে। মনে মনে জপছেন ‘ভোটারবাবা পার করেগা’। এবং তিনি নিশ্চিত, ভোটের বৈতরণী পেরিয়ে যাবেন।
পদ্মই ভূষণ: সাংবাদিকতা, কলাম লেখা তো ছিলই। তখন পকেটে শুধুই কলম। এখন সেই পকেটে পদ্মভূষণ সম্মানও। পদ্মভূষণ হয়েই পদ্ম-প্রতিনিধি হয়েছিলেন রাজ্যসভায়। সেই মনোনীত পদের পরে এখন বিধানসভা ভোটে সরাসরি পদ্ম-প্রার্থী।
রাজ্যসভা-জনসভা: ছিলেন রাজ্যসভায়। এসে পড়েছেন জনসভায়। প্রার্থী হওয়ার পরে মৈত্র-খোঁচায় সাংসদপদ ছাড়তে হয়েছে। সেটা অবশ্য নিয়ম মেনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে করতেই হত। তবে এত জনবহুল জীবনে কস্মিনকালে থাকেননি। আলোচনা সভাতেই চিরকাল বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু এখন সেই জীবনে এসে পড়েছে রোড-শো, পথসভা, মন্দিরে বাবার মাথায় জল ঢালা। আসনটাই তেমন।
ঠেলার নাম মোদীজি: জীবনে কখনও ভোটে লড়ার কথা ভাবেননি। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রীর ঠেলা কি আটকানো যায়! বিজেপি-র মুখিয়ার নির্দেশে বাংলায় বিজেপি-র ‘বৌদ্ধিক মুখ’ হতে এসে পড়লেন। তার পরে আরেক রামঠেলায় হিল্লি-দিল্লি করা স্বপন এখন নির্বাচনের মেঠো লড়াইয়ে সামিল!
তারকা তারকেশ্বর: তিনি কি তারকেশ্বরের ‘তারকা’ প্রার্থী? স্বপন বরং বলেন, ভারত বিখ্যাত তারকেশ্বর নিজেই ‘তারকা’ আসন। কেন? কারণ, বাংলার বাইরের বন্ধু-পরিজনেরা তাঁর লড়াইয়ের আসন জানার পর জিজ্ঞাসাই করেননি— তারকেশ্বরটা কোথায়। বিজেপি-র ‘সর্বভারতীয়’ নেতা মনে করছেন, গ্রামীণ হলেও তারকেশ্বর ভাল আসন। প্রার্থীর মতোই আসনেরও ‘সর্বভারতীয় খ্যাতি’ আছে।
শিবের সঙ্গে শ্যামা: কেন্দ্র শিবের তারকেশ্বর। মনে শ্যাম। থুড়ি, শ্যামাপ্রসাদ। ইতিহাসপ্রিয় স্বপন প্রচারে ১৯৩১ সালের তারকেশ্বর সত্যাগ্রহের কথা না বললেও ১৫ এপ্রিল ১৯৪৭-এর কথা বলছেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে সেদিন বৈঠক হয়েছিল তারকেশ্বরেই। দেশভাগ হয়ে যখন পাকিস্তানের জন্ম হচ্ছে, তখন বাংলাও ভাগ হওয়া দরকার— দাবি উঠেছিল সেদিনই। স্বপন মনে করেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ’ কল্পনার জন্মভূমি হল তারকেশ্বর।
পথে হল দেরি: কিন্তু তারকেশ্বর তার প্রাপ্য গুরুত্ব পায়নি। সেটা স্বপন বুঝেছেন এবং বোঝাচ্ছেনও। বারবার বলছেন, কলকাতা থেকে তারকেশ্বরে আসতে প্রায় দু’ঘণ্টা সময় লাগে। যেটা একঘণ্টার বেশি লাগা উচিতই নয়।
চৈত্রচিত্র: জীবনে প্রথম তারকেশ্বরের চৈত্রের ছবি দেখলেন। আগে কখনও আসেনওনি এখানে। তবে ভোটপ্রচারের মধ্যেই অবাক হয়ে দেখছেন, কত মানুষ কত বিচিত্র প্রার্থনা নিয়ে আসছেন বাবার থানে। যেমন ‘নীলষষ্ঠী’-র চৈত্রে তিনিও নীলবাড়িতে যাওয়ার প্রার্থনা নিয়ে এসেছেন। তবে শিব-শহরের চেহারা দেখে খুব খুশি নন। পরিকাঠামো নেই। উন্নয়ন হয়নি। গাড়ি রাখার জায়গাও নেই। রেলস্টেশন দেখেও অখুশি। তার চেহারাও এমন বিখ্যাত জায়গার সঙ্গে মিল খায় না।
জয় শ্রীরামবাবু: প্রচারে গেলে মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ বলছেন বটে। কিন্তু মনে রাখতে হচ্ছে রামবাবুর কথা। তারকেশ্বরের বহুবারের বিধায়ক ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রাম চট্টোপাধ্যায়কে ওই নামেই চিনত তারকেশ্বর। বুঝেছেন খ্যাত এবং কুখ্যাত মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের রামবাবুকে এখনও ‘রবিনহুড’ মনে করেন শিবের থানের লোকজন। তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প। বুঝছেন, বাকিরা যা-ই ভাবুন, শ্রীরামের থেকেও রামবাবু উজ্জ্বল তারকেশ্বরে।
স্বপন যদি সোপন এমন: হোক সে মিছে কল্পনা। ছোটবেলায় বাবা-মা ‘বাবু’ বলে ডাকলেও কোনওদিন ‘স্বপনবাবু’ হতে পারেননি। নরেন্দ্র মোদী ডাকেন ‘স্বপনদা’ এবং ‘স্বপনজি’। কিন্তু অমিত শাহ নামটাই পুরো বদলে দেন। ডাকেন ‘সোপনদাশজি’। বদ্যি স্বপনের ‘দাশগুপ্ত’-র শেষটুকু ‘গুপ্ত’ই থেকে যায় শাহী সম্বোধনে। যা নিয়ে একদা অরুণ জেটলি খুব রসিকতা করতেন।
মিসিং জেটলি: বন্ধু জেটলিকে খুব মিস্ করছেন। অসময়ে চলে যাওয়া জেটলিকে দেখানো হল না তারকেশ্বর। নিয়ে আসা হল না প্রচারে। তবে বন্ধু-পত্নী সঙ্গীতা নিয়মিত ফোন করে খোঁজ নেন— তারকেশ্বরে কী খাচ্ছেন। কী করছেন।
বেলে পেট তাজা: খাওয়াদাওয়াও কোনও বাছবিচার নেই। তবে চিংড়িতে অ্যালার্জি। রোগ-টোগ বিশেষ নেই। নিজের না থাকলেও মধুমেহকে ‘জাতীয় অসুখ’ মনে করেন। তবে পেট নিয়ে চিন্তায়। অল্প খাচ্ছেন। খালি পেটে বেল আর ভরা পেটে ডাব মাস্ট।
যোগেই বিয়োগ: শরীর ফিট রাখতে যোগাভ্যাস করতে চান। তবে ইচ্ছের থেকে অনিচ্ছাই বেশি। যতবার ধরেছেন তার চেয়েও বেশিবার ছেড়েছেন। শেষবার শুরু করেছিলেন লকডাউনে। আয়ু ছিল হপ্তাদুয়েক।
বই ছেড়ে টইটই: এমনিতে বইপোকা। আগ্রহ মূলত ইতিহাস আর রাজনীতির বইয়ে। অবসর পেলেই বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকেন। কিন্তু এখন সে সব ডকে উঠেছে। দিন রাত মিটিং-মিছিল। অস্থায়ী বাড়িতে ফিরে আবার কর্মী-মিটিং। সিটিংয়ের সময়ও নেই। ফলে বই পড়াও নেই। মিটিং সেরেই স্লিপিং।
বহিরাগত: হুগলির সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ বলতে গুপ্তিপাড়ায় মামাবাড়ি। কলকাতার বাড়ি মহানির্বাণ রোডে। দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্কে। তারকেশ্বরে ভোট উপলক্ষে ভাড়াবাড়ি। ফলে ‘বিহারগত’ আওয়াজ শুনতে হচ্ছে। বিজেপি অবশ্য বলছে, এখন তো এ পাড়ার লোক ও পাড়ায় গেলেও বহিরাগত! আর মনে রাখতে হবে, তারকেশ্বরকে সারা বছর বহিরাগতরাই বাঁচিয়ে রাখেন। স্বপন বলছেন স্কটল্যান্ডের গল্প। একটি পাবে একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনি কি স্থানীয়?’’ উত্তর এসেছিল, ‘‘নাহ্,স্থানীয় নই। পাঁচ মাইল দূরে থাকি।’’
হিন্দি নেহি বোলতা: হিন্দি পুরো বুঝতে পারেন। কিন্তু একটুও বলতে পারেন না। চেষ্টাও করেন না। কেউ বলতে বললে সোজা জবাব দেন, ‘‘ওরে বাবা! ওটা পারব না।’’ আসলে লিঙ্গনির্ণয়েই আটকে যান। শিবলিঙ্গের দেশে গিয়ে পড়েছেন বটে। কিন্তু হিন্দিভাষার লিঙ্গনির্ণয়ের চেষ্টাও করছেন না। জানেন, এটা ভোলেবাবাও পার করাতে পারবেন না।
মোজো-রানি কলিং: তারকেশ্বরে থাকলেও দিল্রির ডাক শুনতে পান। চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িতে আছে মোজো আর রানি। একটি গোল্ডেন রিট্রিভার। অন্যটি কালো ল্যাব্রাডর। অনেক দিন দিল্লি যাওয়া হয় না। মিস্ করছেন খুব। রোজ দু’বেলা খোঁজ নেন। তবু রাত হলেই মন খারাপ। মনে মনে বলেন, ‘‘ভোটটা মিটলেই আসছি!’’
তথ্য: পিনাকপাণি ঘোষ, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী