—ফাইল চিত্র।
বিধানসভা ভোটের পরে নতুন সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে শপথ নেয়নি এখনও। তার আগেই রাজ্য জুড়ে ভোট পরবর্তী হিংসার যুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি ও সিবিআই তদন্তের জোড়া আর্জি জমা পড়ল সুপ্রিম কোর্টে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজ্যে তদন্তকারী দল পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে তদন্তকারীদের দু’সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট জমাও দিতে বলা হয়েছে।
এত দিন আট দফায় নির্বাচন পর্ব চলাকালীন রাজ্যে আদর্শ আচরণবিধি জারি ছিল। সবে সোমবার রাতে তা উঠেছে। নতুন সরকারে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এখনও নবান্নে বসেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার আগেই এ ভাবে শীর্ষ আদালতে ৩৫৬ অনুচ্ছেদে জারির আর্জি জমা পড়ায় তার মূল লক্ষ্য কে, সেই প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত যেখানে সোমবার রাতের পর থেকে নিহতের সংখ্যা তার আগের ২৪ ঘণ্টার তুলনায় কমেছে।
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, ‘‘কেন্দ্র তার সমস্ত এজেন্সি, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে মাঠে নামিয়েও বিজেপিকে ক্ষমতার ধারেকাছে আনতে পারেনি। এখন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকার শপথ নেওয়ার আগেই হিংসায় প্ররোচনা দিয়ে কিছু করার চেষ্টা চলছে। এই আবেদন কে করেছে জানি না। তবে এ সব পিছনের দরজা দিয়ে সামনে আসার কৌশল।’’
তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ও বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শপথ নিলেন না। তৃণমূলের সরকার গঠন হয়নি। কোথাও যদি কোনও হাঙ্গামা হয়ে থাকে, গতকাল রাত পর্যন্ত তাঁর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ছিল। এখনও হয়ে থাকলে, সংবিধানে তার দায়িত্ব কার, সেটা দেখা দরকার। নন্দীগ্রামে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা তো ঠিকই হয়েছে!’’ তাঁর দাবি, আগামিকাল মমতা শপথ নেবেন। বিজেপি চেষ্টা করছে হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িক অশান্তি, মামলা-মোকদ্দমা করে তৃণমূলকে আটকাতে।
মঙ্গলবার ‘ইন্ডিক কালেক্টিভ ট্রাস্ট’ নামে একটি সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা মেনে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির নির্দেশ দেওয়া হোক। সুপ্রিম কোর্টেরই কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল বা এসআইটি গঠন করে এই হিংসায় কোন ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে, তার তদন্ত করানোরও আর্জি জানিয়েছে সংগঠনটি। তাদের হয়ে মামলাকারী জে সাই দীপকের দাবি, রাজ্যে হিংসা রুখতে ও আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রকে সেনা ও সিআরপি মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হোক।
পাশাপাশি, বিজেপির মুখপাত্র ও আইনজীবী গৌরব ভাটিয়া সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে হিংসার ঘটনায় সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, বিধানসভা ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরা তৃণমূলই পরিকল্পিত ভাবে হিংসা চালাচ্ছে। অভিজিৎ সরকারের খুনের ঘটনা তুলে ধরে ভাটিয়া তাঁর আবেদনে যুক্তি দিয়েছেন, খুন হওয়ার ঠিক আগে অভিজিৎ ফেসবুকে একটি ভিডিয়ো আপলোড করেছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছিল, তৃণমূল তাঁর বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। ভাটিয়ার দাবি, হিংসার ঘটনায় ক’টি এফআইআর হয়েছে, কত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যকে প্রশ্ন করুক। কারণ, তৃণমূলের নির্দেশে পুলিশ শাসকদলের নেতা-কর্মীদের নামে কোনও এফআইআর করছে না।
বিজেপি সরাসরি অবশ্য রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তোলেনি। বিজেপির মঞ্চ থেকে সাংবাদিক সম্মেলনের সময়ে দলের মুখপাত্র সম্বিৎ পাত্র ও অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় রাজ্যের হিংসার কথা বললেও রাষ্ট্রপতি শাসনের বিষয়টি এড়িযে গিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি শাসনের প্রশ্নে তাঁদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্যের কাছে রিপোর্ট চেয়েছে। তারপরে প্রশাসনিক স্তরেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে। তবে বিজেপি যে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবছে, তা তাঁরা সাংবাদিক সম্মেলনেই জানিয়েছিলেন। তার পরেই জোড়া মামলা জমা পড়ে। অনির্বাণের বক্তব্য, “যাঁরা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা উচিত, এটা কি ঠিক হচ্ছে? তৃণমূল ও মমতাদিদি কি এই খেলার কথাই বলছিলেন?”
এ দিন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে পশ্চিমবঙ্গের ভোট-পরবর্তী হিংসা ও মৃত্যুর ঘটনার কথা তারা জানতে পেরেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মানবাধিকার রক্ষা করতে স্থানীয় জেলা প্রশাসন এবং আইনরক্ষকদের তরফে কোনও পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এই ঘটনাগুলিকে নিরপরাধ নাগরিকদের বাঁচার অধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সক্রিয় হচ্ছে। কমিশনের কথায়, ‘কমিশন তার ডিআইজি (তদন্ত)-কে অনুরোধ করেছে, তদন্ত বিভাগের অফিসারদের নিয়ে দল গঠন করে ঘটনাস্থলে গিয়ে দ্রুত তদন্ত করা হোক। অন্তত দু’সপ্তাহের মধ্যে সেই তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে হবে।’’
ভোটের আগে তৃণমূলে যোগ দেওয়া অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানার অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হার কথায়, ‘‘মমতা এখনও শপথ নেননি। তার আগেই তাঁর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে ধর্নায় বসে রাজনৈতিক কলকাঠি নাড়তে শুরু করেছে বিজেপি। কোভিডের কী হল প্রিয় বন্ধুরা? নাকি তোমাদের রাজনীতির থেকে তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়? লজ্জা!’’