West Bengal Assembly Election 2021

Bengal Polls: পর্দার আড়ালে কি ভোট কাটার খেলা

Advertisement

অঞ্জন সাহা

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২১ ০৭:২৫
Share:

দেগঙ্গা বিধানসভার চার মূর্তি: রহিমা মণ্ডল (তৃণমূল), হাসানুর জামান চৌধুরী(ফরওয়ার্ড ব্লক), করিম আলি (আইএসএফ), দীপিকা চট্টোপাধ্যায় (বিজেপি)। নিজস্ব চিত্র।

বহু বছর আগের কথা। অশোকনগর-হাবড়া অঞ্চলের এক সময়ের ডাকসাইটে কংগ্রেস নেতা কেশব ভট্টাচার্য ভোটের সভায় সিপিএমের বিধায়ক ননী করের উদ্দেশে বলতেন, ‘‘অরে ননী দেইখ্যা যা, তোগো সিংহ কান্দে!’’ কেশববাবু ছিলেন হাবড়া-বনগাঁ-বারাসতে কংগ্রেসের সকলের ‘কাকু’। হাটেমাঠের সভায় প্রাক্তন বিধায়ক ‘কাকু’-র কথা শুনে সমর্থকদের তালির আওয়াজ গমগম করত। ননীবাবু ছিলেন সিপিএম নেতা। তাঁর দলের প্রতীক ‘সিংহ’ ছিল না। তিনি লোকসভা ভোটে বারাসত কেন্দ্রে ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা চিত্ত বসুর জন্য প্রচার চালাতেন। আর অধিকাংশ সময়ে কাঁদতে কাঁদতেও সিংহ শেষ পর্যন্ত জয়ের হাসি হাসত!
এ বার দেগঙ্গা কেন্দ্রে এসে ক্রন্দনরত সিংহেরই দেখা মিলছে। তবে সে দিন যা ছিল প্রতিপক্ষের নেতার কটাক্ষ, এ বার তা যেন বাস্তব। এই আসনটিতে আব্বাস সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের জন্য দরজা খুলে দিয়েছেন সিপিএমের নেতারা। সেই ফর্মুলা মেনে নেয়নি ফরওয়ার্ড ব্লক। আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় তারা নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে নিজেকে মোর্চার ‘আসল প্রার্থী’ হিসেবে তুলে ধরতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে ফব নেতা মহম্মদ হাসানুর জামান চৌধুরীর। গত বিধানসভা ভোটে এই আসনেই বামফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন তিনি। ভোট পেয়েছিলেন ৭১ হাজারের বেশি। তৃণমূলের জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে ব্যবধান ছিল প্রায় ২৬ হাজারের। হাসানুর ভেবেছিলেন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ায় এ বার কপাল ফিরলেও ফিরতে পারে। কিন্তু উন্নততর বামফ্রন্টের স্লোগান বদলে ভোট-জোটের নতুন খেলায় কোথায় যে কী হয়ে গেল! তা-ও আবার নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উৎসবের সূচনায়।
বারাসত থেকে দেগঙ্গা। সেখান থেকে কিছুটা এগিয়ে বেড়াচাঁপা। রাস্তার উপরে উঠে এসেছে দোকানপাট, বাজার। অটো, টোটোর ভিড়ে হাঁটা দায়। বেড়াচাঁপা বাজারে বন্ধ হয়ে যাওয়া রূপছায়া সিনেমা হলে তৈরি করা নির্বাচনী দফতরে বসে এলাকার সিপিএম নেতাদের উপরে ক্ষোভ উগরে দিলেন ফব প্রার্থী। লোকবলে, অর্থবলে রাজ্যে বামেদের চরম দুর্দিনের মধ্যে বেড়াচাঁপায় ফরওয়ার্ড ব্লকের মতো দলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী দফতরটি দেখলে চমকে যেতে হয়। তেতলা একটি সিনেমা হল ভাড়া করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রার্থীর হয়ে ডিজিটাল প্রচার চালাতে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে একটি দলকে। পেশায় প্রোমোটার হাসানুর দাবি করছেন, সাধারণ বাম কর্মী-সমর্থকদের আশীর্বাদ তাঁর মাথার উপরে থাকবে। কাজটি যাতে সহজ হয়, সে জন্য নিজেকে ‘সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী’ হিসেবে দাবি করে নির্বাচনী দফতরের বাইরে ফ্লেক্স ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাতে সুভাষচন্দ্র, চিত্ত বসু, জ্যোতি বসুর পাশে ইন্দিরা গাঁধীর ছবি। এলাকার দেওয়ালে দেওয়ালে হাসানুর ‘বামফ্রন্ট সমর্থিত ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী’।
দেগঙ্গায় মুসলিম ভোটার ৬৫ শতাংশেরও বেশি। গত বিধানসভা ভোটে মূলত তার উপরে ভিত্তি করেই জিতে এসেছে তৃণমূল। বিদায়ী বিধায়ক রহিমা মণ্ডল এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী। গত লোকসভা ভোটে এই বিধানসভা এলাকা মুখ ফেরায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের থেকে। ফলে ডেঙ্গির সময়ে অব্যবস্থা কিংবা আমপানে দুর্নীতির নানা অভিযোগ থাকলেও এ বারও জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী রহিমা। দাবি করছেন, উন্নয়ন, সম্প্রীতির স্লোগান আর মমতা সরকারের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা তাঁকে জিতিয়ে দেবে। তৃণমূল যুব কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি আনিসুর রহমান এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘‘রাজ্যে তৃণমূলের জন্য একেবারে নিশ্চিত পাঁচটি আসন খুঁজতে গেলে তার একটি দেগঙ্গা।’’ তাঁর আশা, আইএসএফের করিম আলি কিংবা ফরওয়ার্ড ব্লকের হাসানুর বিরাট ভাবে সংখ্যালঘু ভোট কাটতে পারবেন না।
কিন্তু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্রে বসে নেই বিজেপিও। ফরওয়ার্ড ব্লক ও আইএসএফের উপর ভরসা রাখছেন গেরুয়া শিবিরের নেতারা। তৃণমূল, ফরওয়ার্ড ব্লক ও আইএসএফ— তিন দলই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থেকে প্রার্থী দিয়েছে। দলের নেতারা আশা করছেন, বিজেপি প্রার্থী দীপিকা চট্টোপাধ্যায় ‘হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ টেনে নিয়ে’ লড়াইয়ে এসে যাবেন। তার সঙ্গে জুড়বে ভোট কাটার অঙ্ক। লোকসভা ভোটের ফলাফলই তাদের সেই আশা বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে দেগঙ্গায় বিজেপি মাত্র ১২ হাজার ভোট পেলেও লোকসভায় সেই অঙ্ক ৪৩ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। তুলনায় বামেদের ভোট তলানিতে ঠেকেছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের ভোট ৭১ হাজার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজারে। বিধানসভায় একসঙ্গে লড়লেও লোকসভায় বামেদের থেকে আলাদা লড়েছিল কংগ্রেস। পেয়েছিল প্রায় ১২ হাজার ভোট। তবে বিধানসভায় ২৬ হাজার ভোটে জিতে লোকসভা ভোটে দেগঙ্গায় আরও প্রায় ১৭ হাজার ভোট বাড়িয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। বাম নেতারা বলছেন, সে সময়ে মেরুকরণের ভিত্তিতে ভোট হয়েছিল। বাম ভোট ভাগ হয়ে গিয়েছিল তৃণমূল-বিজেপিতে। ফব নেতাদের অবশ্য দাবি, এ বারের ভোট মেরুকরণের ভিত্তিতে না-ও হতে পারে।
তবে এই এলাকায় মুসলিম যুবকদের এক অংশে প্রভাব ফেলছে আইএসএফ। প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ায় ভেসে ভোটারদের একাংশও তৃণমূলের বিপক্ষে। মেরুকরণের আবহে দেগঙ্গার মতো কেন্দ্রে বিজেপি ভিতরে ভিতরে বাড়ছে বলেই মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দা পরিতোষ রায়। বেড়াচাঁপা বাজারে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘আমি নিজে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থক। কিন্তু বুঝতে পারছি, আড়ালে আবডালে পদ্ম ফুটছে।’’ বিজেপি প্রার্থী দীপিকা প্রচারে এনেছেন কাটমানি, আমপান পুনর্বাসনে দুর্নীতির অভিযোগ। বলছেন, ‘‘জিতব। কনফিডেন্ট।’’ বিজেপির আশা, সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগি হবেই। তাতেই আসবে ঘোলা জলে মাছ ধরার সুযোগ। আর তাই কি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দেগঙ্গায় পর্দার আড়ালে অন্য খেলার প্রস্তুতি? খোঁচা খাওয়া সিংহ ঠিক কাকে নিশানা করতে চাইছে, তা নিয়ে ধন্দে এলাকার মানুষ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement