মন্ত্রী হচ্ছেনই, আগাম জানিয়ে হুঙ্কার নির্মলের

নামের পাশে ডাক্তারি ডিগ্রিটা থাকায় মানুষের প্রাণরক্ষায় তিনি দায়বদ্ধ। আবার বিদায়ী বিধায়ক হিসেবে এলাকার মানুষের নিরাপত্তা রক্ষাতেও বড় ভূমিকা থাকার কথা তাঁর। অথচ এ বার তাঁর কারণে ‘মৃত্যুভয়’ পাচ্ছেন তাঁরই এলাকার, তাঁরই দলের মানুষ।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০৪:৫৪
Share:

নামের পাশে ডাক্তারি ডিগ্রিটা থাকায় মানুষের প্রাণরক্ষায় তিনি দায়বদ্ধ। আবার বিদায়ী বিধায়ক হিসেবে এলাকার মানুষের নিরাপত্তা রক্ষাতেও বড় ভূমিকা থাকার কথা তাঁর। অথচ এ বার তাঁর কারণে ‘মৃত্যুভয়’ পাচ্ছেন তাঁরই এলাকার, তাঁরই দলের মানুষ।

Advertisement

তিনি নির্মল মাজি। যাঁর কোপে পড়ার ভয়ে সর্বদা সিঁটিয়ে থাকে এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর।

গোটা দফতরেই কার্যত ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছেন তিনি। এ বার তাঁর দলের কর্মীদের একাংশের মধ্যেও সেই ত্রাস সঞ্চারিত হয়েছে। অভিযোগ, এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে টিকিট দেওয়ার ব্যাপারে দলের মধ্যে থেকেই বিরোধিতা করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের হাড়গোড় ভেঙে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দিয়েছেন নির্মল। ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসে এমনিতেই গোটা রাজ্য বিপর্যস্ত। সেই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সন্ত্রাস-আবহে নতুন মাত্রা যোগ করল বলে মনে করছেন অনেকেই।

Advertisement

হাওড়ার আমতা-১ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ শান্তনু ঘোষের বক্তব্য, ‘‘নির্মল মাজি দলবল নিয়ে বাণীবন, কাদরা, চঙ্গোরার মতো বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আমাদের লোকজনকে চূড়ান্ত হুমকি দিচ্ছেন। বলছেন, ১৯ তারিখের পর মেরে হাত-পা ভেঙে আমতাছাড়া করবেন। আমার একটা ছোট সংস্থা আছে। বলেছেন সেই সংস্থারও ঝাঁপ বন্ধ করে আমাকে ধনে-প্রাণে মারবেন। সত্যিই এ বার মৃত্যুভয় পাচ্ছি।’’ একই অভিযোগ করেছেন উলুবেড়িয়া (উত্তর)-র তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী উত্তম বাকুলি, চন্দ্রনাথ হাজরা, মৃণাল মাইতি, অভিজিৎ অধিকারীরা। এ বার নির্মল যাতে প্রার্থী হতে না পারেন, সে বিষয়ে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের শরণাপন্ন হয়েছিলেন এঁরাই। এমনকী এলাকায় বিক্ষোভও দেখিয়েছিলেন বেশ কয়েক বার। ভোটের প্রচারে এঁরা অনেকেই তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে কাজ করেননি বলেও অভিযোগ।

ওই এলাকার তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই জানিয়েছেন, ভোটের আগে নির্মল এ নিয়ে খুব বেশি মুখ খোলেননি। কিন্তু ভোট মিটে যাওয়ার পরেই তিনি স্বমূর্তি ধারণ করেছেন। শুধু দলীয় কর্মীদের নয়, অভিযোগ, আমতার থানার আইসি ফিরোজ আলি খান-সহ একাধিক পুলিশ কর্মীকে তাঁর হয়ে ভোটের কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন নির্মল। তা না করলে তাঁদের জঙ্গলমহলে বদলি করে দেওয়ার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ। আইসি এই অভিযোগ স্বীকার করেননি। তবে থানার একাধিক কর্মী জানিয়েছেন, কখনও ফোনে, কখনও বা তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে নির্মল নানা ধরনের হুমকি দিয়েছেন। এক কর্মীর কথায়, ‘‘উনি বার বার বলেছেন, এ বার উনি বড়সড় দফতরের মন্ত্রী হবেন। ওঁকে চটালে আমাদের রক্ষা নেই।’’ নির্মল নিজে অবশ্য কোনও অভিযোগই মানতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি হুমকি দিচ্ছি না। উপাসনা করছি। প্রেমই আমার ধর্ম।’’

কেন নিজের দলের অনেকেই তাঁর বিরোধিতা করছেন? নির্মলের জবাব, ‘‘যারা সিপিএম বা বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছে, শুধু তারাই বিরোধিতা করেছে। আমাদের দলের কেউ করেনি।’’ কিন্তু তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে তাঁরা তো দলেরই অংশ। সে ক্ষেত্রে তো বিরোধিতাটা দলের ভিতর থেকেই এসেছে। নির্মল জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছেন।

ভোট মিটে যাওয়ার পরে দিন কয়েক অবশ্য চুপচাপই ছিলেন নির্মল মাজি। আচমকাই তেড়েফুঁড়ে উঠেছেন। একাধিক সরকারি ডাক্তারকে এসএমএস করে জানিয়েছেন, ৩০ থেকে ৪০ হাজার ভোটে জিততে চলেছেন তিনি। কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে আবার ঘোষণা করেছেন, তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। তাঁর কাছ থেকে কে কী সুবিধা চান, তা যেন সকলে ঠিক করে রাখেন। কলকাতা মেডিক্যালে গিয়ে পূর্ত দফতরের অফিসারদের ডেকে হাসপাতালের সম্প্রসারণ নিয়ে বৈঠকও সেরেছেন তিনি।

তবে নির্মল যে দাবিই করুন না কেন, তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন তৃণমূলের চিকিৎসক সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’-এর একাধিক পদাধিকারীর সাম্প্রতিক কিছু আচরণে স্বাস্থ্য দফতরে বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছে। ওই পদাধিকারীরা অনেকেই বাম সমর্থিত সরকারি চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিসেস’-এর নেতাদের ফোন করে কুশল বিনিময় এবং চা খেতে যেতে চেয়েছেন। এমনকী প্রয়োজন পড়লে যাতে ওই সংগঠনে ফিরে যাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করারও অনুরোধ করেছেন। যা দেখে বাম চিকিৎসক সংগঠনের এক নেতার সহাস্য মন্তব্য, ‘‘জাহাজ যখন ডোবে, তখন সবচেয়ে আগে জাহাজ ছেড়ে যায় ইঁদুরেরা। এ ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে কি না কে জানে!’’

এর আগে নির্মলের নানা কীর্তিতে সাধারণত নীরবই থেকেছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। ভোট চলাকালীন অবশ্য সেই ঝুঁকি আর নিতে পারছেন না তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা। এ দিন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দলীয় কর্মীদের নিরাপত্তা ও সম্মান নষ্ট করার চেষ্টা যদি কেউ করেন, তা হলে তিনি যিনিই হন, দল তা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। ওঁরা কি ভাবছেন নির্মলই সব? ওর উপরে আমরা আছি। আমাদের উপরে মমতা আছেন। আমরা দলের সবাইকে বলছি, জিতলে লোকে হৃদয়বান হয়, উদারতা দেখায়, কাউকে মারে না।’’

রাজ্য জুড়ে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস নিয়ে দু’দিন আগেই সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘নির্মলকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছি না। সামগ্রিক ভাবে যা বলার আগেই বলেছি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement