তিনি ভোটে দাঁড়াননি। কিন্তু আলোচনায় বিলকুল আছেন।
সেই অপহরণ-পর্ব থেকেই।
কে তাঁকে অপহরণ করেছিল, কোথায় রেখেছিল, কী ভাবে তিনি অক্ষত ফিরলেন— তার অনেকটাই এখনও ধোঁয়াশা। কিন্তু তাতে তাঁর সংবাদ শিরোনামে থাকতে বাধেনি, ভোটের প্রচারেও না।
তিনি দেবজ্যোতি রায়।
১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাম সমর্থিত সেই নির্দল কাউন্সিলর, যাঁকে কান্দি পুরসভায় আস্থাভোটের ঠিক দু’দিন আগে তাঁর স্কুল থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। আস্থা ভোটে মিটে যাওয়ার দু’দিন পরে বীরভূমের পথে ফেলে যাওয়া একটি গাড়িতে পুলিশ তাঁকে খুঁজে পায়।
এখন তিনি কংগ্রেস প্রার্থী অপূর্ব সরকারের (তামাম কান্দি ‘ডেভি়ড’ বলে চেনে) দিকে ঝুঁকে আছেন। এবং তৃণমূলের সন্ত্রাস বোঝাতে বারবার ওই গল্পটাকেই ফিরিয়ে আনছেন ডেভিড। আনছেন আরও দু’টো গল্প:
এক, গত নভেম্বরে পুরভবন লাগোয়া হ্যালিফক্স মাঠে শুভেন্দু অধিকারীর সভায় দিনে-দুপুরে শূন্যে গুলি চালিয়ে, পিস্তল উঁচিয়ে নাচতে নাচতে তৃণমূলের মিছিল ঢোকা।
দুই, গত পুরভোটে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেসের পরাজিত প্রার্থী আজিজুল হকের স্ত্রীর আত্মঘাতী হওয়া। ডেভিডের অভিযোগ, ‘‘২০টি মিথ্যা মামলায় আজিজুলকে ফাঁসিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল পুলিশ আর তৃণমূল। সইতে না পেরেই তাঁর স্ত্রী আত্মঘাতী হয়েছেন। এই সন্ত্রাস কান্দি আগে কখনও দেখেনি।’’
সন্ত্রাসের তালিকা ছাড়াও একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে ডেভিড-বাহিনী— ‘বহিরাগত’ প্রার্থীকে কান্দির মানুষ ভোট দেবেন কি?
‘বহিরাগত’ কে তা আর আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার নেই। কান্দির প্রার্থী হিসাবে শান্তনু সেনের নাম ঘোষণার পরে বেশ কিছুক্ষণ তৃণমূলের অন্দরে কেউ বুঝে উঠতে পারছিল না, কে ইনি। পরে জানা যায়, তিনি পেশায় রেডিওলজিস্ট। নিবাস দমদম। কলকাতা কর্পোরেশনে দু’বারের কাউন্সিলর।
‘বহিরাগত’ প্রার্থী বদলে জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি তথা কান্দির ভূমিপুত্র উজ্জল মণ্ডলকে দাঁড় করানোর খামবন্দি আর্জি পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারীকে দিয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। কল্কে পাননি।
শান্তনু অবশ্য অনেক লম্বা সুতো টেনে আনছেন— ‘‘আমার আদি বাসস্থান বহরমপুর শহরের ইন্দ্রপ্রস্থ। বহিরাগত এখানের বিধায়ক। তাঁর শিকড় তো পূর্ববঙ্গে। সেই হিসেবে কান্দি থেকে বহরমপুর কাছে, নাকি বাংলাদেশ? উত্তর দেবেন মানুষ।’’ ডেভিডের দাদা পার্থ সরকারের পাল্টা, ‘‘বাবার জন্ম পূর্ববঙ্গে হলেও আমরা চার ভাই জন্মেছি কান্দি হাসপাতালে। ওইটুকু খবর যিনি জানেন না, তিনি কান্দির ৪ লক্ষ মানুষের খবর রাখবেন কী উপায়ে!’’
আপাতত বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে গিয়ে ভোটারদের মনের এক্স-রে করছেন রেডিওলজস্টি শান্তনু। বলছেন, ‘‘১০ বছরে এখানকার বিধায়কের সম্পত্তি ৭ লক্ষ টাকা থেকে বেড়ে ৪ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা হয়েছে। সাংসদ, বিধায়ক, পঞ্চায়েত সমিতি, পুরসভা, পঞ্চায়েত— সবই কংগ্রেসের। উন্নয়ন কিন্তু বিধায়কের সম্পদের মতো লাফিয়ে বাড়েনি।’’
পাল্টা তালিকা দিচ্ছেন ডেভিড— ‘‘ফি বছরের বন্যা থেকে রক্ষা পেতে অধীর চৌধুরীর উদ্যোগে ইউপিএ সরকার কান্দি মাস্টার প্ল্যান করেছে। ভাগীরথী থেকে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানীয় জলপ্রকল্পও করেছে। কান্দির ২৫৯টা বুথ সড়কপথে যুক্ত হয়েছে। নিকাশি, পার্ক, বাস টার্মিনাস, পথে-পার্কে আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। উন্নয়ন না দেখতে পেলে চোখের চিকিৎসা করাতে হবে।’’
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট বেঁধেছিল। প্রার্থী ছিলেন কংগ্রেসের পরিষদীয় নেতা কান্দির ‘রাজাবাবু’ অতীশ সিংহ। জোট অস্বীকার করে কান্দিতে ‘কুড়ুল’ প্রতীকে ডেভিডকে দাঁড় করান তদানীন্তন জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। অতীশকে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে ডেভিড বিধায়ক হন। গত বার ‘হাত’ চিহ্নে জেতেন ডেভিড। এ বার তিনি বাম-কংগ্রেস জোটপ্রার্থী।
হ্যাটট্রিক করতে পারবেন কি?
পাটিগণিত বলছে, ২০১১ সালে বাম ও কংগ্রেসের মিলিত ভোট ৮৭ শতাংশ থেকে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে নেমে আসে ৬৪ শতাংশে। বিজেপি টেনে নেয় চার শতাংশ, বাকি ১৯ শতাংশ তৃণমূল। এর পরের দেড় বছরে তৃণমূল যে আড়ে-বহরে আরও বেড়েছে, অনাস্থা প্রস্তাব এনে তাদের কান্দি পুরসভা দখল তার অন্যতম প্রমাণ। কিছু দিন আগেও ডেভিডের ছায়াসঙ্গী ছিলেন যুবনেতা শাশ্বত মুখোপাধ্যায়। তিনি সদ্য তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
শাশ্বত বলছেন, ‘‘২০০৬ সালের ভোটে কান্দির মানুষ পরম ভালবাসায় বাড়ির উঠোনে তুলসী লাগিয়েছিলেন। দশ বছর যত্ন-আত্তি করে বাড়িয়ে তোলার পরে দেখা গেল, তা আসলে বিছুটি। সেই বিছুটি উপড়ে ফেলতে আমরা এখন এককাট্টা।’’
তৃণমূলের দাবি, বামেরা সমর্থন করা সত্ত্বেও কংগ্রেসের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে তৃণমূল। রেডিওলজিস্টের এক্স-রে প্লেটে সেই ছবিই ধরা পড়ছে।
রিপোর্ট মিলবে ১৯ মে।