জামুড়িয়ার নন্ডী গ্রামে তৃণমূল ও বিজেপি কর্মীদের হাতাহাতি। —ওমপ্রকাশ সিংহ।
সকাল থেকেই ভোটের আঁচে তপ্ত শিল্পাঞ্চল। বেলা যত বাড়ল মাথার উপর সূর্যের সঙ্গে তাপ বাড়ল বুথে, এলাকাতেও। বিকেল পর্যন্ত কোথাও বিরোধী এজেন্টদের বাধা, কোথাও মার-ভাঙচুর, কোথাও বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠল। কিছু জায়গায় পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধেও নিস্ক্রীয়তার অভিযোগ ওঠে।
স্বমূর্তিতে হিরা
সম্প্রতি দলনেত্রীর দুর্গাপুরের সভায় মঞ্চে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। দলীয় সূত্রের খবর, ভোট করানোর বিশেষ দায়িত্বও তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। নিরাশ করেননি দুর্গাপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলরহিরা বাউরি। সোমবার সকাল থেকেই স্বমূর্তিতে ভোটের ময়দানে দেখা যায় তাঁকে। ভোট শুরু হওয়ার ঘন্টা দু’য়েক পরেই তামলা প্রাথমিক স্কুলের সামনে কংগ্রেসের দুটি বুথ ক্যাম্প অফিসে হিরার দলবল চড়াও হয় বলে অভিযোগ। চেয়ার-টেবিল উল্টে দেওয়া হয়। কাঠের বেঞ্চ ছুড়ে ফেলা হয় পাশের নর্দমায়। জোট প্রার্থী কংগ্রেসের বিশ্বনাথ পাড়িয়ালের ফ্লেক্স ছিঁড়ে ফেলা হয়। দু’জন কংগ্রেস কর্মীকে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। তারপরে কেন্দ্রীয় বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসায় পালিয়ে যায় তারা। সমস্ত অভিযোগ অবশ্য নস্যাৎ করে দিয়েছেন হিরা বাউড়ি। এর আগেও হিরার বিরুদ্ধে টাকা না পেয়ে রাস্তা তৈরিতে নিযুক্ত ঠিকাদার ও তাঁর আত্মীয়কে মারধর, চাঁদা চেয়ে না পেয়ে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্তাকে মারধর, দলীয় কার্যালয়ে ডেকে এনে পারিবারিক বিবাদ মেটানোর সময় এক মহিলাকে চড় মারার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে কাউন্সিলর হিরা বাউড়ির বিরুদ্ধে।
দুপুর ১টা নাগাদ ফরিদপুরে ফের হিরা বাউড়ির বিরুদ্ধে হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে। কংগ্রেসের অভিযোগ, ১৬২ থেকে ১৬৭ নম্বর বুথের জন্য দলের ক্যাম্প অফিসে হামলা চালায় হিরা বাউরির অনুগামীরা। অফিসটি ছিল স্থানীয় কংগ্রেস কর্মী সুভাষ সাহার দোকানে। অভিযোগ, তাঁর দোকানে ঢুকে হামলাকারীরা আসবাবপত্র, পাখা প্রভৃতি ভাঙচুর করে।
বাইরে ডেকে মার
তখন সকাল সাড়ে ১১টা। বেনাচিতির সুভাষপল্লির নেতাজি হিন্দি হাইস্কুলের বুথের সামনে বাম-কংগ্রেসের ক্যাম্প অফিসে তৃণমূলের মোটরবাইক বাহিনী তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ। কর্মীদের অভিযোগ, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সাদা কাপড়ে মুখ ঢেকে ক্যাম্প অফিসে ঢুকে পড়ে কয়েকজন। তারপরে সেখানে বসে থাকা জোট কর্মীদের নাম ধরে ডেকে বের করে তিন জনকে মারধর করা হয়। কংগ্রেসের জেলা শিল্পাঞ্চল সভাপতি দেবেশ চক্রবর্তীর দাবি, ১১১ নম্বর বুথে কংগ্রেসের এজেন্ট ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা দীপা কবিরাজ। তাঁর বাড়িতেও হামলা হয়। দীপাদেবীর অভিযোগ, ‘‘আমার ভাইকে মেরেছে। মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অথচ পুলিশ-প্রশাসন নীরব।’’ অভিযোগের তির যাঁর দিকে সেই তৃণমূল কাউন্সিলর নিমাই গড়াইয় যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বারাবনির সত্তা ছোটকড়ো এলাকার ১৫৭, ১৫৮ নম্বর বুথের বিজেপি পোলিং এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেওয়ারও অভিযোগ জমা পরে নির্বাচন কমিশনে। কাশকুলি এলাকার ১৫৯ নম্বর বুথে বিজেপির এজেন্টকে এবং বারাবনির পুটুলিয়া এলাকার ১৫১ নম্বর বুথে সিপিএমর পোলিং এজেন্টকে বুথে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ ওঠে।
প্রার্থীকে ঢুকতে বাধা
বীরভানপুরে ২৪২, ২৪৩ ও ২৪৪ নম্বর বুথে নির্বিঘ্নেই ভোটপর্ব চলছিল। বেলা দুটো নাগাদ ওই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ দুবে বুথগুলিতে ঢুকতে গেলে তাঁকেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা বাধা দেন বলে অভিযোগ। ক্ষোভ প্রকাশ করেন কল্যাণবাবু। নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগও জানান। পরে সংশ্লিষ্ট আধিকারিক এসে বিষয়টি মিটিয়ে দেন।
এজেন্টকে বাধা
ভোট শুরুর আধঘন্টা আগে পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রের শঙ্করপুরের তিনটি বুথে সিপিএমের এজেন্ট ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। পরে অবশ্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতায় সমস্যা মেটে। ডালুরবাঁধ কোলিয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে সিপিএমের এজেন্ট কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়কে হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ। তাঁর হাত থেকে কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁকে লক্ষ্য করে গালিগালাজও করা হয় বলে অভিযোগ। চশমা ভেঙে গিয়েছে ওই এজেন্টের। কৃষ্ণাদেবীর দাবি, কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলেও তারা নীরব ছিল। তৃণমূল অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বড়গোড়িয়া গ্রামের একটি বুথেও সিপিএমের এজেন্টকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। পরে তিনি অবশ্য ফের বুথের ভিতরে ঢোকেন।
প্রাণে মারার হুমকি
বুথে ঢুকতে বাধা তো ছিলই, বালুডাঙা বাঁকোলা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের একটি বুথে সিপিএম এজেন্ট রাজকুমার ভুঁইয়াকে বুথ ছেড়ে না গেলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তিনি কর্ণপাত না করায় তাঁর বাড়িতে হামলা চালায় তৃণমূল। সিপিএমের পক্ষ থেকে এমনই অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া গোগলা এলাকায় কয়েকটি বুথে সিপিএমের এজেন্টদের বুথে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। বারাবনি বিধানসভা কেন্দ্রের পাঁচগাছিয়া এলাকার ২৩২ নম্বর বুথেও সিপিএম পোলিং এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সিপিএমের দাবি, স্থানীয় তৃণমূল নেতা পাপ্পু উপাধ্যেয়ের লোকজনেরা তাঁকে তুলে নিয়ে যান। ঘন্টা দুই পরে ওই এজেন্ট গৌরমোহন কুন্ডুর হদিস মেলে। প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘জোটের এজেন্ট হয়েছিলাম বলে শাসক দলের লোকেরা আমার বাড়িতে হুমকি দিচ্ছিল। তাই বুথ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম’’ পাপ্পুবাবুর দাবি, ‘‘তাঁকে কেউ তুলে নিয়ে যায়নি। তিনি নিজেই চলে যান।’’ দুপুর ২টো নাগাদ কল্যা প্রাথমিক স্কুলের ১১৩ ও ১১৪ নম্বর বুথে ঘুরে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ ওঠে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তিনি নিজের নাম জানান, বিকাশ মণ্ডল। বলেন, ‘‘আমি তৃণমূল নেতা। আমার স্ত্রী স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যা।’’ কিন্তু এ ভাবে বুথে ঘুরছেন কেন? তাঁর উত্তর, ‘‘প্রভাবিত করিনি। ভোটারদের সাহায্য করতে এসেছি।’’
গাজন নষ্ট
চৈত্রের বিকেল। রোদের তেজ তখনও কমেনি। গাজনের উৎসবে মেতে রয়েছেন বীরভানপুরের বাসিন্দারা। অভিযোগ, এক জায়গায় কয়েকজনকে জড়ো দেখে আচমকা টহলদার গাড়ি থেকে নেমে লাঠি চালাতে শুরু করেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা। মারের চোটে অমিত দত্ত ও সুবল পাল নামে দু’জন জখম হন। তাঁদের স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে ভর্তিও করানো হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাহিনীর সঙ্গে বচসা, গোলমালে বেশ কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণ বন্ধও থাকে ওই কেন্দ্রে।
সরলেন কর্তা কুলটির নিয়ামতপুর এলাকার ধর্মশালার ৩৫ নম্বর বুথে দেখা যায় এক মহিলা ভোটারের ভোট অন্য এক জন দিয়ে দিচ্ছেন। পরে এই অভিযোগে ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরীকে সরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন।