বিনপুরের লালজল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে মোট ভোটার ৩৩১ জন। সোমবার নির্বাচনের দিন ভোট দিয়েছেন ৩৩১ জনই!
সে দিন ৯৯ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে এমন বুথও অজস্র!
গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়মে ভোটদানের এই হার কি স্বাভাবিক? নাকি এই ঘটনাই বলে দিচ্ছে, ভূতেরা এখনও রয়েছে এবং ভোটের দিনে তারা নেত্যও করেছে?
জঙ্গলমহলে তৃণমূলের ভোট ম্যানেজার শুভেন্দু অধিকারীর অবশ্য ব্যাখ্যা, ‘‘পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ মমতাদির কাছ থেকে একশো ভাগ পেয়েছেন। তাই একশো ভাগ ভোটও দিয়েছেন।’’ তাই বলে একশোয় একশো? শুভেন্দুর জবাব, ‘‘জঙ্গলমহলের মানুষ সিপিএমের হাত থেকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন, তাই হাত খুলে ভোট দিয়েছেন।’’
কিন্তু এই যুক্তি মানতে নারাজ অনেকেই। প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে যেমন বললেন, ‘‘আমি কখনও ১০০% ভোট পড়ার কথা শুনিনি। এটা স্বাভাবিক ঠেকছে না। তবে দেখতে হবে, ওই সব বুথে অতীতে কেমন ভোট পড়েছে।’’ আর এক প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ও মনে করেন,‘‘ এ জিনিস হতে পারে না। ৯০% ভোট কোথাও কোথাও হতে পারে। তা বলে, ১০০% ভোট ঠিক স্বাভাবিক লাগছে না।’’ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন বলেন, ‘‘দেখতে হবে, কত বুথে এমন ঘটনা ঘটেছে। যদি দেখা যায় যে, বেশ কিছু বুথে প্রায় সকলেই ভোট দিয়েছেন, তা হলে কমিশনের তা খতিয়ে দেখা উচিত।’’
কমিশনের কাছে এমন দাবিই জানিয়েছে বিরোধী দলগুলি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের কাছে যে ধরনের তৎপরতা আশা করা হয়েছিল, তা দেখা যায়নি। অনেক জায়গায় জানলা খুলে ভোট হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায় ছিল? পর্যবেক্ষকদের দেখা মেলেনি। রাজ্য পুলিশ বুথের ভিতরে কী করছিল?’’ আগামী পর্বের ভোটে যাতে এমনটা না হয়, কমিশনকে সে দিকে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
ভোটের দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় ভোটদানের যে হিসেব কমিশন দিয়েছিল, দু’দিন পরে তা বেড়ে গিয়েছে প্রায় তিন শতাংশ। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস। এর পিছনেকোনও কারচুপি আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশনকে তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য। বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন,‘‘কমিশন তো বৈ়জ্ঞানিক রিগিং রুখবে বলে হম্বিতম্বি করেছিল। কোথায় গেল সেই হুঙ্কার। বাকি দফায় যাতে ভূতেরা ভোট দিতে না পারে কমিশনকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’’
কমিশনের অবশ্য হেলদোল নেই। রাজ্য নির্বাচনী অফিসারের মুখপাত্র দিব্যেন্দু সরকার বলেন, ‘‘কোনও অস্বাভাবিকত্ব মেলেনি। প্রতিটি ভোটার যাতে ভোট দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা কমিশন করতে চায়। ভোট বেশি পড়ায় কমিশন খুশি।’’
খুশি শাসক দলও। জঙ্গলমহলে ভোট শুরুর অনেক আগেই তৃণমূল নেতারা দাবি করেছিলেন, যা ব্যবস্থা হয়েছে তাতে বিরোধীদের মাঠের বাইরে বের করে দেওয়া হবে। সোমবার পশ্চিম মেদিনীপুরের ছ’টি এবং বাঁকুড়ার দু’তিনটি কেন্দ্রে শাসক দলের দাপাদাপি দেখা গিয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারি না-থাকার সুযোগ নিয়ে ভোটের আগের রাতে গ্রামে গ্রামে বিরোধী ভোটারদের বাড়ি গিয়ে ভোট দিতে না-যাওয়ার হুমকি ছিলই। কোথাও কোথাও বলে দেওয়া হয়েছিল কোন চিহ্নে বোতাম টিপতে হবে। ভোটের দিন ভোটারদের গাড়ি করে বুথে নিয়ে আসে শাসক দলের কর্মীরা। কোথাও বুথে ঢোকার আগে ভোটারদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় গরম আলুর চপ আর মুড়ির ঠোঙা। বুথের বাইরে মস্ত জমায়েত করে চোরা সন্ত্রাসে বের করে দেওয়া হয় বিরোধী দলের কর্মীদের। জঙ্গলমহলের শাসক দলের এক নেতার কথায়, ‘‘ভূত আর কোথায় খুঁজবেন? সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। প্রথম পর্বের ১৮টি আসনের মধ্যে ১৫টিই আমরা পাব।’’
শাসক দলের এই আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক রাজ্যে বেশ কয়েকটি ভোট পরিচালনা করা এক আমলা। তাঁর প্রশ্ন, বুথের বাইরে কেন্দ্রীয় বাহিনী আর ভিতরে ৫০% মহার্ঘ ভাতা না পাওয়া সরকারি কর্মী। তাঁদের ফাঁকি দিয়ে ভূতেরা ভোট দেবে কী করে? তাঁর কটাক্ষ, ‘‘ভূত তো ভূতই! তাই উল্টো নেত্যও করা অসম্ভব নয়।’’
কিন্তু নেত্য যার পক্ষেই যাক, প্রথম দফা ভোটের পর গন্ধটা বেশ সন্দেহজনক।