ভোট দিয়ে তৃণমূলের দেওয়া মুড়ি নিয়েই বাড়ি ফেরা। সোমবার বেলপাহাড়ির বুড়িঝোড়ে দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
নেতাইয়ের রথীন দণ্ডপাটের বাড়ি ছাড়াতেই দেখা হয়ে গেল যুবকের সঙ্গে। দোহারা চেহারা। আড়চোখে এ দিক সে দিক দেখে নিয়ে বললেন, ‘‘নাম লিখবেন না তো?’’
আশ্বস্ত করার পরে বললেন, ‘‘যারা যারা বিরোধীদের ভোট দিতে পারে, এমন সবার বাড়ি গিয়ে গত দু’তিন ধরে ওরা বলে এসেছে, ‘দ্যাখো, এই সব বাহিনী-ফাহিনী দিন কয়েক থেকে চলে যাবে। যা করবে ভেবে-চিন্তে করবে।’ এর পর আর কার ঘাড়ে ক’টা মাথা!’’
৫০ ফুট দূরে নেতাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে তখন বেশ বড়সড় লাইন। স্কুলের দরজায় স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে সিআরপি জওয়ান। ভিতরে ইতস্তত আরও কয়েক জন। দলনেতার ব্যবহার বেশ ভাল। আঙুল তুলে দেখালেন স্কুলবাড়ির ছাদে ট্রাইপড-এর উপরে এলএমজি বসানো রয়েছে। প্রিসাইডিং অফিসার বেরিয়ে এসে জানালেন, প্রথম দু’ঘণ্টায় ২০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে গিয়েছে।
ভিতরে এজেন্ট বলতে অবশ্য শুধু একজন। না বললেও চলে, তিনি তৃণমূলের। বাম জমানায় এই এলাকায় যে সন্ত্রাসের বাতাবরণে নির্বাচন হতে দেখেছি, তার সঙ্গে আজকের ফারাক এটাই যে বুথের ভিতরে ঢুকে দাদাগিরিটা নেই। কিন্তু বাইরের ছবিটা অনেকটা একই। নেতাই থেকে লালগড় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সেই ‘একতরফা’ রাজনীতি। যার মন্ত্রই হচ্ছে বিরোধীকে মাথা তুলতে দেওয়া যাবে না। তখন কেন্দ্র থেকে এত বাহিনী পাঠিয়ে ভোট করার চল ছিল না। ফলে বুথের ভিতরে-বাইরে ‘জোর যার মুলুক তার’-এর খেলা চলত। এখন কৌশলে বাহিনীকে বুথের ভিতরে রেখে বাইরে চলছে ‘মিঠে সন্ত্রাস’। হয়তো সর্বত্র নয়। কিন্তু কোথাও কোথাও তো বটেই।
কী রকম? লালগড়ের চাঁদাবিলায় ভোটকেন্দ্র থেকে বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার বসে জনা কুড়ি যুবক। সবুজ বস্তার ভিতরে মুড়ির প্যাকেট সাজানো। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ভোট দিয়ে যিনিই বেরোবেন, তাঁকে ওই রাস্তার উপর দিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে। তাঁর পথ আটকে দেওয়া হবে মুড়ির প্যাকেট। একটু আগে যখন হেঁটে ভোট দিতে গিয়েছেন, তখনই মুড়ি উপহারের আগাম খবর দেওয়া হয়েছে। যুবকদের মধ্যে থেকে জিতেন দুলে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘খুব শান্তিতে ভোট হচ্ছে।’’
হুবহু সংলাপ এল পুরুলিয়ার বলরামপুরে ঘাটবেড়া-কেরোয়া উচ্চতর বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রেও। স্কুলের বাইরেই সাইকেল নিয়ে রীতিমতো ব্যূহ সাজিয়ে পজিশন নিয়েছেন শাসক দলের মাতব্বররা। ওই রাস্তা দিয়ে বুথে ঢোকে মাহুলিটাঁড় বা কলাবেড়া কলোনির মতো স্পর্শকাতর কয়েকটি গ্রাম। কেরুয়া গ্রামের ভক্ত মণ্ডল-সুখেন মণ্ডলেরা সহাস্যে শুধোলেন, ‘‘ভোট দেখতে যাচ্ছেন? যান! এখানে পুরা শান্তিতে ভোট চলছে।’’ শান্তির আরও নমুনা টের পাওয়া গেল বিকেলে বলরামপুর শহরে ফুলচাঁদ হাইস্কুলের কাছে। কংগ্রেস প্রার্থী জগদীশ মাহাতো রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ করেছেন, কমিশন বা কেন্দ্রীয় বাহিনীর চোখে ধুলো দিতে মুড়ির মধ্যে লুকিয়ে টাকা-পয়সা বিলি করা হচ্ছে। মসজিদের গলির কাছে আগের দিন রাতে ভোলা সরেনের বাড়ি মাংস-ভাতের ‘ফিস্ট’ হয়েছে। পুরুলিয়ার জেলা সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর বিরুদ্ধেও দেদার টাকা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে।
লালগড় সদরে লালগড় স্কুলের গেট থেকেও বড়জোর ৩০-৪০ মিটার দূরে জটলা করে ছিলেন জনা দশেক যুবকের দল। যাঁরা স্কুলে ঢুকছিলেন, তাঁরা সেই জটলা পেরিয়েই আসছিলেন। শুনেছিলাম, ভোটকেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে কোনও জমায়েত করা যাবে না, কিন্তু এখানে তো অন্য ছবি! বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর যিনি দলনেতা তাঁকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, ‘‘ভোটকেন্দ্রের ভিতরটা আমাদের দেখার কথা, বাইরেটা নয়। ওটা পুলিশ দেখবে।’’ যার অর্থ, বাহিনীকে কার্যত ‘বুথবন্দি’ করে খেলাটা বাইরেই হচ্ছে।
সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত সিজুয়া, ধরমপুর, নেতাই, দ্বারিগেড়িয়া, ভূলাডাঙা-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে একটিও টহলদারি জিপ চোখে পড়েনি। আবার আগে যেমন দেখতাম, ভোট-কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে চেয়ার-টেবিল পেতে, সামিয়ানা টাঙিয়ে দলগুলোর অস্থায়ী ছাউনি, তেমন ছাউনিও নজরে আসেনি। কারণ, বিরোধীশূন্য এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শাসক দলের আশ্রিত যুবকের দল।
বাড়ির দাওয়ায় বসিয়ে যে প্রৌঢ় মানুষটি জল খাওয়ালেন, তাঁর কথায়, ‘‘সন্ত্রাসের ধরনটা বদলে গিয়েছে। গ্রাম-কে-গ্রাম যুবকের যে দল এক সময়ে মাওবাদী আন্দোলনে ভিড়েছিল, তারাই এখন শাসক দলের নেতৃস্থানীয়। তারা জানে, শাসক দলের সঙ্গে না থাকলে হাজারো পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হবে। আগে পুলিশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করত। এখন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাস করে।’’ দু’টাকার চাল, সাইকেল, কন্যাশ্রীর টাকার বদলে সেই সন্ত্রাস সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই আমজনতার।
নেতাইয়ের ওই যুবককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘ধরুন, আপনার নাম দিয়ে লিখলাম, কাল খবরের কাগজে বেরোল। তা হলে কী হতে পারে?’’ যুবকের উত্তর ছিল, ‘‘পরিবার নিয়ে বাড়িছাড়া হতে সময় লাগবে না।’’
(সহ-প্রতিবেদন: ঋজু বসু)