রাজ্যের ২৯৩টি আসনেই তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেবল একটি আসন বাদে।
সেই আসনটি জিততে মমতা-নামের কোনও দরকার নেই। একাই একশো পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা।
অমুক কেন্দ্রে তমুক নয়, সব কেন্দ্রে তিনিই প্রার্থী— বারবার নানা কেন্দ্রে প্রচারে গিয়ে এই আপ্তবাক্য আউড়ে চলেছেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু নবদ্বীপ বলছে, ‘‘ও সব দল-টল বুঝি না। নন্দদাকে (পুণ্ডরীকাক্ষ) চিনি। তাঁকে দেখেই ভোটটা দেব।”
পুণ্ডরীকাক্ষ তিন বারের বিধায়ক, নবদ্বীপের প্রথম মন্ত্রী। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, তিনিই এ শহরের মুশকিল আসান। পৌষের কনকনে মাঝরাতে শব্দদৈত্য ধরতে তিনি পথে নেমে পড়েন। স্নিকারস ভেজার ভয়ে হেভিওয়েট মন্ত্রী যখন বানভাসি নবদ্বীপ অর্ধেক দেখেই কনভয় ঘুরিয়ে ফিরে যান, তিনি ঘোলাজলে ডোবা শহরের গলিঘুঁজিতে ঘুরে বেড়ান বারমুডা পরে, গামছা গায়ে। চাঁদার জুলুমে জড়িত কর্মীদের বাধ্য করেন ক্ষমা চাইতে। সারদা-নারদায় তৃণমূল যখন নাকাল, তাঁর সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পান না বিরোধীরাও।
নবদ্বীপ তাই নন্দ সাহাই বোঝে।
প্রচারের শেষ পর্বে এসে কেমন বুঝছেন অবস্থা?
মহামিছিলের প্রস্তুতি সারার ফাঁকে নন্দ বলেন, “মূল্যায়ন তো মানুষ করবেন।” আপনি কি বুঝছেন? দ্রুত ভেবে নিয়ে নন্দ বলেন, “আগের ভোটগুলোয় শহরের লিডটা গ্রামে গিয়ে কমে যেত। কিন্তু এ বার ব্লকের ফলও খুব ভাল হবে।” কেন? নন্দ বলেন, “আগে আমি বিধায়ক হলেও রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল বামপন্থীরা। যা করতে চাইতাম তাতেই বাধা পেতাম। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্য জুড়ে যে উন্নয়নের কর্মকাণ্ড চলেছে, তা মানুষ নিজেদের দিয়ে উপলব্ধি করেছেন।”
মমতা?
লোকে তো বলছে নন্দই সব?
বিব্রত হয়ে পড়েন পুণ্ডরীকাক্ষ— “যে কেউ তাঁর মতো করে ভাবতেই পারেন। এ নিয়ে আমি কি বলব?” তবে সেই সঙ্গে এ-ও মনে করিয়ে দেন যে, মন্ত্রিত্বের প্রথম দিন থেকেই তাঁর লালবাতি লাগানো সরকারি গাড়ির সামনের সিটে নেত্রীর প্রমাণ সাইজের ছবি বসানো থাকে।
ভোটারদের একাংশের মুগ্ধতায় অবশ্য ভাসতে রাজি নন বিরোধীরা। শহর জুড়ে অসংখ্য প্রমাণ সাইজের ফ্লেক্সে যে উন্নয়নের ছবি আঁকার চেষ্টা করছেন নন্দ আর তাঁর লোকজন, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে সিপিএম থেকে শিবসেনা, বিজেপি থেকে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন। জোটপ্রার্থী, সিপিএমের সুমিত বিশ্বাস বলেন, “গত পুরভোটে যে সব প্রকল্প দেখিয়ে উন্নয়নের জোয়ার এসেছে বলে দাবি করেছিল তৃণমূল, সেই ক’টা প্রকল্পই এই ভোটেও বিধায়কের সাফল্য বলে তুলে ধরা হচ্ছে। এ যেন সেই একই কুমিরছানার গল্প। মানুষ এখন জানতে চায়, কোনটা বিধায়কের কাজ আর কোনটা পুরসভার।”
সুমিতের অভিযোগ, নবদ্বীপ ব্লকে গ্রামের মানুষের অবস্থা দুর্বিষহ। গত বন্যায় সব ক’টি রাস্তা জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছিল। আজও সেখানে এক টুকরো খোয়া পড়েনি। বসতবাড়ি ভেঙেছিল যাঁদের, ন্যূনতম সাহায্য পাননি। অথচ বিধায়ক তাঁরা এলাকা উন্নয়ন তহবিলের টাকা খরচ করতে না পারায় তা ফিরে গিয়েছে। উল্টে বাম আমলে নবদ্বীপ পুরসভার করা বাসস্ট্যান্ড ও সুলভমূল্যের গেস্টহাউস ভেঙে তুলে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। পিপিপি মডেলের নামে এক শ্রেণির প্রমোটারের হাতে জলের দরে সরকারি জমি তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে পুরসভা। সুমিতের দাবি, ‘‘প্রাক্তন পুরপ্রধান এবং তিন বারের বিধায়ক হিসাবে উনি এ সব অস্বীকার করতে পারেন না।’’
বিজেপির নবদ্বীপ কেন্দ্র আহ্বায়ক তথা প্রাক্তন সভাপতি জীবন সেনও টিপ্পনী কাটেন, “পনেরো বছর ধরে নবদ্বীপ তো পিছন দিকে এগিয়েছে! উন্নয়ন মানে কি প্রমোটারের হাতে জমি তুলে দিয়ে একের পর এক বেআইনি ফ্ল্যাট তৈরি করা? প্রতি বার বন্যায় ভেসে যায় যে শহর সেখানে নদীবাঁধ নিয়ে কিছু হয় না কেন? তাঁত শিল্পী, কাঁসা-পিতল শিল্পীদের অবস্থা দিনের পর দিন খারাপ হয়েছে! মানুষ ভোটের বাক্সে এর জবাব দেবে।”
মজার কথা, সিপিএমকে যদি লড়াইটুকুও দিতে হয়, তা হলে তাদের বিজেপিরই ভোট ভাঙাতে হবে। গত লোকসভা ভোটে মোদী-হাওয়ায় বাম ভোটব্যাঙ্ক থেকে ৮ শতাংশ এবং তৃণমূলের বাক্স থেকে ৫ শতাংশ ভোট ছিনিয়ে নিয়েছিল বিজেপি। সেই ভোট যার জায়গায় ফিরে গেলে নন্দ সাহা হইহই করে জিতবেন। দৈবাৎ যদি বিজেপির হাতছাড়া হওয়া পুরো ভোট জোটের দিকে চলে যায়, তা হলেই সেয়ানে সেয়ানে টক্কর হবে।
তবে, এত দূর বোধহয় জোটের নেতারাও ভাবছেন না!