প্রচারে আলাপ। বাঁকুড়ার তালড্যাংরায় সিপিএমের প্রার্থী অমিয় পাত্র।— নিজস্ব চিত্র।
শ্যাওলা রঙের এসইউভি থেকে নামলেন শীর্ণকায় প্রবীণ। তাঁরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা খাতড়া-সিমলাপাল যাওয়ার রাস্তায়, পুখুরিয়া মোড়ে। কিন্তু তিনি যে তিনি-ই, চিনতে অসুবিধে হল। এ কী চেহারা হয়েছে অমিয় পাত্রের!
তিন মাসে ওজন কমেছে ১২ কেজি। এর মধ্যে পাঁচ কেজি শুধু গত এক মাসে! ৬৪ বছরের অমিয়বাবু এক গাল হেসে বললেন, ‘‘খুব সকালে প্রচারে বেরোচ্ছি। ফিরতে সেই রাত। এ তো হবেই।’’ দলে ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, মানসিক চাপে ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকছে না সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ‘অমিয়দা’র। নিয়মিত ওষুধ খেয়েও ফাস্টিং ব্লাড সুগারই ১৪০-এর নীচে নামছে না।
রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর ছ’জনকে এ বার প্রার্থী করেছে দল। অমিয়বাবু তাঁদেরই এক জন। বাঁকুড়া জেলায় সিপিএমের সব চেয়ে ওজনদার নেতা। দাঁড়িয়েছেন জঙ্গলমহলের তালড্যাংরা কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রেই ১৯৮৭ থেকে টানা দু’বার জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন। ১৯৯৫-এর এপ্রিলে দলের জেলা সম্পাদক হওয়ার পরে ১৯৯৬-এ ভোট ময়দান থেকে সরে দাঁড়ান। তার পরে টানা কুড়ি বছর জেলায় দলের মাথায়।
একটা সময়ে জেলা সিপিএমের অন্দরে অমিয় পাত্রের লোকেদের সঙ্গে পার্থ দে-র ঘনিষ্ঠদের বিরোধ চর্চার বিষয় ছিল। কিন্তু অমিয়বাবুর দাপটে বিরোধী গোষ্ঠী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ২০১২-য় দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন অমিয় পাত্র। আর ২০১৫ সালে জেলা সম্পাদক পদ থেকে সরে গিয়েও বাঁকুড়ায় দলের অভিভাবক।
নমুনা? এখনও তিনি স্কুলডাঙায় দলের জেলা কমিটির অফিসে ঢুকলে জেলা সম্পাদক অজিত পতি চেয়ার ছেড়ে দেন। শুধু বাঁকুড়া নয়, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে তিনি পুরুলিয়া এবং মালদহ জেলারও দায়িত্বে। দলের মধ্যে না-পসন্দ জিনিসটি বাইরেও বরাবর স্পষ্ট বলেন তিনি। যেমন, ২০১০-এ পশ্চিম মেদিনীপুরে সিপিএম যখন সশস্ত্র শিবির গড়ে মাওবাদীদের হাত থেকে এলাকা ‘পুনর্দখল’ করছে, তখন অমিয়বাবু বলেছিলেন, ‘‘বাঁকুড়ায় এমনটা হতে দেব না। এটা সে-ই মানুষের উপরে জোরজুলুমই হবে।’’ ২০১১-র ভোটের সময়ে তৃণমূলের দখলে থাকা বাঁকুড়া পুরসভা সম্পর্কে সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘‘ওরা কাজ করেনি ঠিকই। কিন্তু দুর্নীতি করেছে এমন মিথ্যা অভিযোগও করব না।’’
তবে বিরোধীরা, এমনকী, এ বার খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তালড্যাংরায় প্রচারসভায় গিয়ে নাম না করে বলে এসেছেন, ‘তালড্যাংরার যিনি এ বার সিপিএম প্রার্থী তিনি গড়বেতা ও চমকাইতলায় গোপন পথে গুন্ডা পাঠাতেন’। হাসেন অমিয়বাবু। ‘‘তা হলে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে ওঁরা আমার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলেন না কেন?’’
তালড্যাংরার পাত্রবাঁধ গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান সেই অমিয়বাবুকে আবার দু’দশক পরে নির্বাচনী ময়দানে নামতে হয়েছে। এ বার আর দলের জেলা অফিসে বসে জেলার ১২টা বিধানসভায় ‘কী করতে হবে, কী ভাবে করতে হবে’ ঠিক করা বা সতীর্থদের জন্য প্রচার নয়, তিনি নিজেই লড়াইয়ে।
২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোট, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে পর পর ধাক্কা খেয়ে কার্যত গর্তে ঢুকে গিয়েছিল সিপিএম। কিন্তু বামফ্রন্ট কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর জবরদস্ত লড়াইয়ে নেমেছে। আর সেখানেই ভোট-ময়দানে প্রত্যাবর্তন অমিয় পাত্রের, যাতে তাঁকে দেখে দলের নিচুতলা চাঙ্গা হয়। অমিয়বাবু বলছেন, ‘‘রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরা ভোটে না দাঁড়ালে মানুষের কাছে একটা ভুল বার্তা যেত যে, আমরা জিতব না। সরকার গড়ার মতো অবস্থাতেও পৌঁছব না। এখন লোকে একটা বিকল্প দেখতে পাচ্ছে।’’
তা বলে বসে নেই তালড্যাংরার বাম প্রার্থী। গরমে চরকিপাক খাচ্ছেন। বহু বছরের অভ্যাস, রুটি বাদ গিয়েছে ভোট-ডায়েটে। ঢুকেছে ঝোল-ভাত। সকালে চা-মুড়ি খেয়ে বেরোচ্ছেন। মাঝে বিস্কুট, কখনও কখনও ওআরএস মেশানো জল। কারণ, প্রচুর ঘাম ঝরাতে হচ্ছে এ লড়াইয়ে।
বামেরা যদি তালড্যাংরার তৃণমূল প্রার্থী সমীর চক্রবর্তী ওরফে বুয়াকে বহিরাগত (সল্টলেকের বাসিন্দা) বলেন, তবে এলাকায় গিয়ে অমিয়বাবুও শুনেছেন, ‘‘আপনাকেও বাইরের লোক বলা যায়। এখানে তো বহু বছর দেখিনি।’’ এমনকী, তৃণমূলের প্রচারে বলা ‘অমিয়বাবুর সল্টলেকে বাড়ি আছে’— বিশ্বাস করেছেন ভোটারদের একাংশ।
এলাকাবাসী মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘ডাং’ বা লাঠি দিয়ে পাকা ফল পাড়ার পদ্ধতিকে স্থানীয় ভাবে বলা হয় ‘ড্যাংরা’। বার বার ঘা দিতে হলে বলা হয় ‘আরও ড্যাংরা’। আবার বছর কুড়ি পরে ভোটে নেমে ইপ্সিত ফল পেতে হলে অমিয়বাবুকে ‘ড্যাংরা’তে হবেই। তাতে শরীর পাতন? ‘‘পরোয়া নেই’’, বলছেন অমিয় পাত্র।